মঙ্গলবার , ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ২৩শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
  1. অপরাধ
  2. অর্থনীতি
  3. অস্ট্রেলিয়া
  4. আন্তর্জাতিক
  5. আফ্রিকা
  6. আবহাওয়া
  7. আমেরিকা
  8. আয়ারল্যান্ড
  9. ইউক্রেন
  10. ইউরোপ
  11. ইতালি
  12. কানাডা
  13. খেলাধুলা
  14. গ্রাম বাংলা
  15. চিত্র বিচিত্র

ঋণের বোঝা নিয়ে প্রবাসে ১০ বছর

প্রতিবেদক
Probashbd News
সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২২ ২:১৬ অপরাহ্ণ

Spread the love

‘২৪ বছর বয়সে প্রবাস জীবন শুরু। বিদেশে প্রতিটা রাতেই কান্না করেছি। ঋণের বোঝা টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। একমাত্র ছেলেকে হাফেজ বানানোর ইচ্ছা থাকলেও তার পড়ালেখাও শেষ করাতে পারিনি। খুব ছোট থেকে সংগ্রাম করে বড় হয়েছি। এমন কোনো কাজ ছিল না যেটা করিনি। ইচ্ছে হয় আমার জীবনের করুণ কাহিনি দেশের মানুষকে জানাতে।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন কুমিল্লার নাঙ্গলকোট থানার কুয়েত প্রবাসী শাহ জামাল রিপন। পরিবারের সুখের আশায় তিন লাখ টাকায় ২০১১ সালের শুরুতে উড়াল দেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুবাই।

তিনি মাত্র ১৭ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন ক্লিনিং কোম্পানিতে। যেখানে ৩ লাখ টাকার পুরোটাই ছিল সুদের ওপর নেওয়া। ফলে প্রতি মাসে তাকে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা সুদ দিতে হতো। আর এই টাকা জোগাড় করতে তিনি প্রবাসে সব কাজ করেছেন।

শাহ জামাল বলেন, এভাবে সংসার চালানো যাচ্ছিল না। একদিকে পরিবারের খরচ অন্যদিকে মোটা অঙ্কের সুদের ওপর ঋণ। কাজের পাশাপাশি একবার বিক্রি করতে লাগলাম সিডি, ক্যাসেট ও পান। ২ বছর পর কোম্পানি আমিসহ ৪৭ জনকে লাইফ গার্ড ট্রেনিংয়ে পাঠায়। সেই ট্রেনিং যে কত কষ্টের তা বোঝানো সম্ভব না। সবার মধ্যে একমাত্র আমিই পাস করি। এই ট্রেনিংয়ে কত যে সুইমিংপুলের পানি আমাকে খেতে হয়েছে তা একমাত্র আমিই জানি। আমাকে যে সফল হতেই হবে। এরপর বেতন কিছুটা বেড়ে ৩০ হাজারে দাঁড়ালো।

‘ততদিনে ঋণ বেড়ে ৪ লাখ টাকা হয়ে গেছে। ঋণের চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারতাম না। এবার ডিউটির পাশাপাশি শুরু করলাম গাড়ি ওয়াশ করা। রাতদিন পরিশ্রম করায় কয়েক বছর পর ২০১৭ সালে ঋণ অনেকটা কমে আসে। ঠিক তখনি পড়লাম মহাবিপদে।’

তিনি বলেন, ২০১৭ সালের শেষের দিকে আমার দুই পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়। ফলে চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ যেতে বাধ্য হই। ইনস্যুরেন্স কোম্পানির সহযোগিতায় ঢাকার এভারকেয়ার (তৎকালীন অ্যাপোলো) হাসপাতালে দুই পায়ের অপারেশন হলো। মোটামুটি সুস্থ হয়ে ৪ মাস পর আবার দুবাই ফিরলাম।’

দেশে যাওয়াতে আবার ঋণ বেড়ে গেলো। আগের কাজ আর পেলাম না। গাড়ি ওয়াশ করে যেটা আয় করতাম সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। কোম্পানির অনুমতি নিয়ে শুরু করলাম খাবারের ব্যবসা। নিজেকে মোটামুটি গুছিয়ে নিলাম।

এদিকে দেশে থাকার জন্য আবার ঋণ করে ৫ লাখ টাকা দিয়ে জায়গা কিনলাম। আমিসহ আরও কয়েকজন মিলে যে আরবির ভিলায় রুম ভাড়া নিয়ে খাবারের ব্যবসা করতাম, হঠাৎ সেখানে একদিন রাত ২টায় পুলিশের হানা। আমরা প্রায় ৫০ জন ছিলাম সেখানে। সবাইকে নিয়ে যায়। সব ডকুমেন্ট থাকার পরও আমাকে দেশে পাঠিয়ে দেয়। বলছিলেন শাহ জামাল।

জানান, দেশে ফেরার পর একেবারে ভেঙে পড়েন। একদিকে ঋণের বোঝা, অন্যদিকে পরিবার চালাতে হিমশিম। যে ছেলেকে কোরআনের হাফেজ বানাতে চেয়েছিলেন, তার পড়ালেখা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কোনো বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন আর ফোন ধরে না। বিদেশে থাকাকালীন যারা খবর নিত এখন আর কেউ খবর নেয় না।

তোর উপলব্ধি হলো, সুসময়ে সবাইকে পাশে পেলেও অসময়ে কেউ পাশে থাকে না। উপায়ান্তর না পেয়ে মেজ ভাই আর ভাতিজার সহযোগিতায় এবার নিজ গ্রামে একটা ছোট রেস্টুরেন্ট দিলেন। যেখানে শাহ জামাল নিজে কারিগর আর ছেলেকে মেসিয়ার হিসেবে নিযুক্ত করলেন।

শাহ জামাল বলেন, যে ছেলের জন্য আমি স্বপ্ন দেখতাম, সেই স্বপ্ন ভেঙে তাকে এত কিশোর বয়সে আমার সঙ্গে কাজে লাগিয়ে দিলাম। করোনার কারণে রেস্টুরেন্ট তেমন চলছিল না। সুদে আমার ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ টাকার ওপরে। দোকানে যা আয় হতো তা দিয়ে কোনোরকম সংসার চালাতাম। আমার অসময়ে স্ত্রী সবসময় পাশে ছিলেন।

‘এত অভাব অনটন থাকার পরও কখনো কটুকথা বলেনি। সেই সময় অর্থনৈতিকভাবে শাশুড়ির কাছ থেকেও প্রচুর সহযোগিতা পেয়েছি। এক বছর দুই মাস পর যখন আর পারছিলাম না তখন মেজ ভাই কুয়েত নিয়ে আসলেন। ভিসা খরচে ঋণ আরও পাঁচ লাখ বেড়ে যায়। আবারো ক্লিনিং কোম্পানিতে কাজ শুরু করি। বেতন এবার ২১ হাজার টাকা।’

অসময়ে আমি কারো কাছ থেকে সহযোগিতা না পেলেও আমার মেজ ভাইয়ের থেকে পেয়েছি। তার ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারবো না। কুয়েতে আসার পর নিজের সঙ্গে নিজে লড়াই করে চলছি। ভাই সবসময় ভরসা দিয়ে যাচ্ছেন।

‘এখন যে কোম্পানিতে আছি সেটার অবস্থাও তেমন ভালো না। কোম্পানির ডিউটির পাশাপাশি একটা পার্টটাইম জব করছি। ১৫ লাখ টাকার ঋণ যে আমাকে শোধ করতে হবে। যার বেশিরভাগই সুদের ওপর। আমি আমার পরিবারকে তো বলেই দিয়েছি, ঋণ শোধ করার আগে যদি আমার মৃত্যু হয় আমার লাশ যেন দেশে না যায়।’ যোগ করেন শাহ জামাল।

কত কষ্টের প্রবাস জীবন! ১১ বছর ধরে ঋণের বোঝা টানতে হচ্ছে প্রবাসী শাহ জামালের। সুদ টানতে টানতে যেন তার জীবন শেষ। দিন রাত পরিশ্রম করেও কূল-কিনারা নেই তার। যখনি একটু স্বস্তিতে জীবন পার করবে বলে ভাবেন, তখনি যেন অন্যকোনো বিপদ এসে ভর করে।

ঋণ যতক্ষণ একটা মানুষের ঘাড়ে থাকবে, পরিশোধ না করা পর্যন্ত তার শান্তির ঘুম কখনো আসবে না। আর এর ভুক্তভোগী বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রবাসীরাই হন। যার ফলাফল হিসেবে আমরা পাই প্রবাসীদের লাশ। প্রচুর প্রবাসী এই ঋণের বোঝা নিয়ে স্ট্রোক করে মৃত্যুবরণ করেন। কেউবা বেছে নেন আত্মহত্যার পথ।

সর্বশেষ - প্রবাস

Translate »