মাওলানা হাসান বিন মোহাম্মদ উল্লাহ
প্রবাস মানেই নিঃসঙ্গতা, প্রবাস মানেই একাকিত্ব, প্রবাস মানেই হাড়ভাঙা পরিশ্রম। তবুও প্রবাস জীবন শেখায় জীবনকে উপলব্ধি করতে, শত বাধা উপেক্ষা করে এগিয়ে চলতে। প্রবাস জীবনটা আকর্ষণীয় হলেও এখানে আপনি একজন বনবাসী।
কেউ কর্মজীবনের কিছু সময়ের জন্য প্রবাসী হন, কেউবা সারা জীবনের জন্য। কেউ আর্থিক সচ্ছলতা, শারীরিক সুস্থতা আর মানসিক প্রশান্তি নিয়ে ঘরে ফেরেন, কেউবা লাশ হয়ে। এ জীবন কারো জন্য সুখের, আবার কারো জন্য দুঃখের। নিজের পরিবার এবং দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্যই এ পথে আসা।
জীবিকার তাগিদে পরিবার-পরিজন ছেড়ে অগত্যা পরবাসের খাতায় নাম লেখানোর নামই প্রবাস জীবন। প্রতিদিনই নিত্য-নতুন ঘটনার সম্মুখীন হওয়া ও অভিজ্ঞতার ভান্ডার বৃদ্ধি করার নামই প্রবাস জীবন। সবকিছুকে পেছনে ফেলে জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার নামই প্রবাস জীবন।
দেশি বলে ডেকে বুকে জড়িয়ে ধরার নামই প্রবাস জীবন। নিরাশার অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া ছেলেটার ফেক হাসির নামই প্রবাস জীবন। সবকিছু হারিয়েও কিছুই হারাইনি বলে নিজেকে মিথ্যা শান্ত্বনা দেওয়ার নামই প্রবাস জীবন। দু’চোখের নোনাজলে সুখ খোঁজবার নামই প্রবাস জীবন। এ জীবন বড় কষ্টের, বড় দুঃখের।
প্রবাস জীবন একজন প্রবাসীকে পুরোপুরি বদলে দেয়। এখানে অনেক বখাটেও বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে ভালো মানুষ হয়ে যায়, আবার কিছু ভালো মানুষও বখাটে হয়ে যায়। লবণ বেশি হওয়ার কারণে চিৎকার-চেঁচামেচি করা ছেলেটাও এখানে অখাদ্যকে অমৃত সুধা মনে করে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে।
সকাল ১০টার আগে যেই ছেলের ঘুম ভাঙতো না, প্রবাসী হওয়ার কারণে সেই ছেলেটাও সূর্যিমামার আগে উঠে যায়। সামান্য মাথা ব্যথার অজুহাতে ফাঁকি দেওয়া ছেলেটাও জ্বর-ঠান্ডা, রোদ-বৃষ্টিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় স্বউদ্যমে। আড্ডাবাজি, নেশার জগতে লাখ লাখ টাকা উড়ানো ছেলেটাও আজ মানুষের ধার-দেনার চিন্তায় প্রতিটি টাকা খরচ করতে দু’বার ভেবে।
দামি মোটরসাইকেল ছাড়া যার চলেই না, সে এখন স্বচক্র-যানে পাড়ি দেয় অনেক পথ। বাস মিস হলে পায়ে হেটেই কর্মস্থলে পৌঁছে। মায়ের আঁচলতলে বেড়ে ওঠা ভীতু ছেলেটাও আজ হাজার মাইল দূরে নির্ভীক দিবানিশি কাটায়।
নরম বিছানায় গা এলিয়ে ঘুমানো ছেলেটাও আজ গাদ্দা বিছিয়ে ফ্লোরে ঘুমায়। এক কথায় নিজের সমস্ত সুখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে এ জীবনে পদার্পণ করে, শেষ জীবনে আরেকটু ভালো থাকতে, পরিবারকে আরেকটু ভালো রাখতে।
প্রবাসে পাড়ি জমাবো, কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি। জীবিকার তাগিদে সবাইকে ছেড়ে পরবাসের খাতায় নাম লেখাতে হলো। যাইহোক, কর্মজীবনে বহু প্রবাসীকে নিঃস্ব হতে দেখেছি। দেখেছি তাদের অন্তরিস্থ বোবা-কান্না আর আত্ম-চিৎকার। এর একটাই কারণ আর তা হলো, নিজের জন্য সঞ্চয় কিংবা ভবিষ্যতের একটা স্থায়ী আয়ের রাস্তা তৈরি না করা।
আপনাকে সর্বদা মাথায় রাখতে হবে যে, এই দেশটা আমাদের নয়, যেকোনো মুহূর্তে বিদায় নিতে হবে। আর তাই বিদায় বেলায় খালি হাতে ফিরে গেলেও দারিদ্র্যতার দুর্দশা যেন পেয়ে না বসে, সেজন্য আগ থেকেই ছোটখাটো কিছু একটা করতে হবে। অতি আত্ম-নির্ভরশীল কিংবা ওভার-কনফিডেন্স নিয়ে হুট করেই দেশে চলে যাবেন না।
আপনার তেমন কোনো অ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশন নেই, তবুও এক হাজার ইউরো বেতন দিচ্ছে, কিন্তু দেশে দশ থেকে বিশ হাজার টাকা বেতনেও কেউ রাখবে না। আর যা হোক দেখা যাবে এমন জেদি মনোভাব নিয়ে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবেন না। সময় এবং টাকা দুটোকেই কাজে লাগান। আর যদি বিদেশ থেকে আসতেই হয় তাহলে কিছু একটা করার নিয়তে আসুন।
আপনার টাকায় ভাই-বোন মানুষ হলো, মা-বাবার চিকিৎসা হলো, আত্মীয়-স্বজনরা উপকৃত হলো, আপনার টাকায়ই সংসারের সব চাহিদা পূরণ হলো, কিন্তু যখনই দেশে চলে গেলেন তখন কেউ আর আপনাকে চিনবে না। আপনি তখন বাদামের খোসা।
অন্যদিকে স্ত্রী-সন্তানের জন্য আলাদা করে কিছু না করার কারণে তাদের কাছেও লাঞ্চিত হবেন। আর এটাই চরম বাস্তবতা। প্রবাসী পরিবারগুলোর অশান্তির মূলেই রয়েছে এসব। সত্যি বলতে প্রবাসীকে কেউ কখনো ভালোবাসেনি, কেউ না, বেসেছে শ্রেফ তার টাকা-পয়সাকে।
যতদিন স্বার্থ থাকবে ততদিন ভালোবাসা কায়েম থাকবে, যখনই স্বার্থ ফুরিয়ে যাবে ঠিক তখনই ভালোবাসা ঘৃণায় পরিণত হবে। তাই আরেকবার ভাবুন, বুদ্ধিমান হোন, পরে যাতে পস্তাতে না হয়। মহান আল্লাহ্ প্রবাসীদের দুঃখ লাঘব করুন, আমীন।
লেখক: মাওলানা হাসান বিন মোহাম্মদ উল্লাহ, ইমাম ও খতীব: বায়তুল মোকাররম বাংলাদেশ মসজিদ, মাদ্রিদ, স্পেন