ভয় জেগেছিল, বৃষ্টির জল না জানি আবার কান্না হয়ে জমে সাকিব আল হাসানদের চোখে! তীরে এসে তরী ডোবার গল্পটাও তো আর নতুন নয় বাংলাদেশের জন্য। শেষমেশ তাই হলো আরেকবার। শেষ বলে গিয়ে হারল বাংলাদেশ।
অ্যাডিলেড ওভালে বৃষ্টির আগে রীতিমতো রূপকথার জন্ম দিচ্ছিল লিটন দাসের যাদুকরি ব্যাটিং। বৃষ্টি এসে তাতে দিল বাগড়া। পরে কনকনে হিমেল হাওয়ায় নতুন লক্ষ্যের লড়াইটা খুব সহজ ছিল না।
তবে ৫৪ বলে ৮৫ রানের টার্গেটটা একেবারে অসম্ভব কিছুও নয়। হাতে দশ উইকেট। তেমন একটা মঞ্চ পেয়েও হয়নি। খেলাটা শেষ ওভার অব্দি উত্তেজনার তুঙ্গে থাকল। জয়ের স্বপ্ন বেঁচে থাকল শেষ বলটি পর্যন্ত। কিন্তু মিলল না সমীকরণ!
২০১৫ সালে যে মাঠে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল বাংলাদেশ সেখানে এবার হাত ফসকে বেরিয়ে গেল আরেকটা জয়, যেটি হতে পারত আরেকটি ঐতিহাসিক জয়!
তবে নিশ্চিত করেই পয়সা-উসুল হওয়া এক ম্যাচ উপহার দিয়েছেন টাইগাররা। যেখানে জয় হয়েছে শেষমেশ ক্রিকেটেরই।
শেষ ওভারে এসে হলো ম্যাচের ফয়সালা; সেমি-ফাইনালের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার ম্যাচে ডাকওয়ার্থ লুইস মেথডে ভারত জিতল ৫ রানে। এই হারে সেমির দরজা এক প্রকার বন্ধই হয়ে গেল বাংলাদেশের জন্য। হারলেও লড়েছে দারুণ- এই শান্তনাটুকুই কেবল সঙ্গী হলো।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মহা গুরুত্বপূর্ণ এই ম্যাচে জয়টা জরুরি ছিল দুই দলেরই। সেমি-ফাইনালের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার এই ম্যাচে টস জিতে ভারতকেই প্রথমে ব্যাটিংয়ে পাঠায় বাংলাদেশ। বিরাট কোহলির হাফসেঞ্চুরিতে তারা ২০ ওভারে ৬ উইকেট হারিয়ে তোলে ১৮৪ রান। জবাব দিতে নেমে বাংলাদেশ ৭ ওভারে বিনা উইকেটে ৬৬ রান তুলতেই ওভালে নেমে আসে বৃষ্টি! মাঠে হাজির প্রায় হাজার চল্লিশেক দর্শকের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দেয় অনাহুত সেই অতিথি। তারপর তো সর্বনাশ বাংলাদেশের…।
বৃষ্টিতে কমে চার ওভার। এ অবস্থায় ১৬ ওভারে বাংলাদেশের দরকার ছিল ১৫১ রান। মানে শেষ ৯ ওভারে সাকিবদের চাই ৮৫ রান। হাতে আছে এখনো ১০ উইকেটই।
কিন্তু বৃষ্টির পর প্রথম ওভারেই উইকেট হারায় বাংলাদেশ। রান আউট হন লিটন দাস। লোকেশ রাহুলের সরাসরি থ্রোতে সর্বনাশ। ২৭ বলে তিন ছক্কা ও সাত চারে ৬০ রান তুলে ফেরেন লিটন। তার আগে ২২ বলে ফিফটি তুলে নেন যা কিনা এবারের বিশ্বকাপের দ্বিতীয় দ্রুতগতির ফিফটি।
লিটনের পর নাজমুল হোসেন শান্তও আটকে যান। তিনি ফেরেন ২৫ বলে ২১ রানে। এখানেই যেন ম্যাচটাও হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। শেষের দিকের কেউ আর লিটনের লড়াইটাকে পূর্ণতা দিতে পারলেন না। ১৬ ওভারে ৬ উইকেটে ১৪৫ রানে আটকে গেল বাংলাদেশ। শেষ ওভারে জিততে ২০ রান প্রয়োজন থাকলেও সেটি আর করা হয়ে উঠল না! কিন্তু খুব কাছে গিয়েই হারল দল। তাসকিনের এক ছয় আর সোহানের এক চারে শেষ ওভারেও জয়ের সুযোগ দেখে বাংলাদেশ। শেষ বলে প্রয়োজন পড়ে ৭ রান। ৬ মারতে পারলে টাই হয়ে যেত ম্যাচ। কিন্তু সেই বলে হলো ১ রান।
অথচ আজ পুরোটাই হতে পারত বাংলাদেশের গল্প। কারণ একজন লিটন লড়ছিলেন একা! মনে হচ্ছিল ভারতের ছুড়ে দেওয়া ১৮৪ কোন ব্যাপারই নয়। তার ব্যাটে একেকটা শট শিল্পীর তুলির আঁচড় যেন। লিটন দাস যেদিন খেলেন সেদিন সবুজ মাঠের ক্যানভাসে এমনই মায়াজাল ছড়িয়ে পড়ে!
বুধবার ভারতকে পেয়ে শুরু থেকেই ভিন্ন এক মেজাজে দেখা যায় লিটনকে। প্রিয় পজিশন ওপেনিংয়ে নেমে সেই সহজাত ব্যাটিং, চার ছক্কার ফোয়ারা। তাকে আটকাতে কত কী যে করলেন রোহিত শর্মা। বোলিংয়ে একের পর এক পরিবর্তন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। বাংলাদেশের এই ওপেনার উড়লেন। তাণ্ডব চালালেন। ঝড় বইয়ে দিলেন অ্যাডিলেড ওভালে।
কিন্তু এখানে বৃষ্টি বড্ড বেরসিক। লিটন-ঝড়ের পর বৃষ্টিতে খেলা হলো বন্ধ। যখন ভারতের কোনো বোলারই আটকাতে পারছিলেন না তাকে, তখন বৃষ্টি থমকে দিল লিটনকে। ৭ ওভারে বাংলাদেশ তুলে নেয় বিনা উইকেটে ৬৬ রান। তখন ডিএল মেথডে সাকিব আল হাসানের দল ১৭ রানে এগিয়ে। বৃষ্টি না হলে জিততো বাংলাদেশই।
তবে সেই বৃষ্টি থেমেছে কিছু পরেই। দ্বিতীয়বার মাঠে নেমে খেলার মোমেন্টামই হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। লিটনের রান আউটে শুরু হয় বিপর্যয়। দাঁড়াতে পারেননি আর কেউ। সাকিব আর সোহান চেষ্টা করেছিলেন, তবে শেষরক্ষা আর হয়নি।
এর আগে অ্যাডিলেড ওভালে টস জিতে প্রথমে রোহিত শর্মাদের ব্যাট করতে পাঠান সাকিব আল হাসান। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক ছিল সেই প্রশ্নটা উঠবেই। কারণ বোলাররা ঠিকঠাক কাজটুকু করতে পারেননি। সঙ্গে ফিল্ডিংটাও যুতসই হলো না!
এদিনও প্রথম উইকেটটা পেতে পারতেন তাসকিন আহমেদ। একদম ম্যাচের শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের কৌশলে বোকা বনে ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন রোহিত শর্মা। সীমানার সামনে হাসান মাহমুদের হাতে পড়েছিল একেবারে সহজ ক্যাচ। কিন্তু সেটি হাতে জমাতে পারেননি তিনি। ১ রানে জীবন পান ভারতীয় অধিনায়ক। তখন ভারতের ছিল ১০ রান!
তবে প্রায়শ্চিত্ত করতে দেরি করেননি হাসান। ক্যাচ হাতছাড়া করার পরের ওভারে বোলিংয়ে এসে সেই রোহিতকেই দেখিয়ে দেন সাজঘরের পথ। অফ স্টাম্পের বাইরের বলে খেলতে না পেরে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ক্যাচ তুলে দেন ইয়াসির রাব্বির হাতে। ২ রানে ফেরেন রোহিত। হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন হাসান!
এরমধ্যে সাকিব একটা সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। কোনো বিরতি ছাড়াই সেরা অস্ত্র তাসকিনের বোলিং একটানা শেষ করে দেন। এক স্পেলে এই পেসার চার ওভার করে দেন মাত্র ১৫ রান। রোহিতের ক্যাচটা হাসান না ফেললে একটা উইকেটও পেতে পারতেন তিনি! এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এবারই প্রথমবার কোনো ম্যাচে উইকেটশূন্য থাকলেন তাসকিন।
তাসকিন রান না দিলেও থেমে থাকেনি ভারত। রান উৎসব চলে তাদের। গ্যালারির গর্জন বাড়িয়ে খেলতে থাকেন লোকেশ রাহুল। তবে ফিফটি করার পর তাকে তুলে নেন সাকিব। জোরে হাঁকাতে গিয়ে শর্ট ফাইন লেগে ক্যাচ তুলেন মুস্তাফিজুর রহমানের হাতে। তাতেই ভাঙে লোকেশ-বিরাট কোহলির ৩৭ বলে ৬৭ রানের জুটি। লোকেশ বিদায় নেন ৩২ বলে ৫০ রানে। ইনিংসে ছিল চার ছক্কা ও তিন চার। ভারত তখন ১০ ওভারে ২ উইকেটে ৮৬।
তারপর ম্যাচের লাগাম বাংলাদেশের হাতে আনার কয়েকটা সুযোগ তৈরি হয়। ১১তম ওভারে মুস্তাফিজুর রহমানের ওভারের সময় বিরাট কোহলি হতে পারতেন রান আউট। পরের ওভারে সাকিবের বলে সূর্যকুমার যাদবের ক্যাচ মিস করেছেন মুস্তাফিজ।
কিন্তু সূর্যকুমার ঠিকই ফাঁদে পড়েন পরে। তাকে বোল্ড করেন সাকিব। সাকিবের সোজা আসা বলে কাট করতে চেয়েছিলেন সূর্যকুমার। লাইন মিস করে বোল্ড হয়ে যান তিনি। তার আগে খেলে যান ‘ইম্প্যাক্ট’ফুল এক ইনিংস। ১৬ বলে চার চারে করেন ৩০ রান। এই উইকেট তুলে নিয়ে নতুন উচ্চতায় পা রাখেন সাকিব। টিম সাউদির সঙ্গে যৌথভাবে এখন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তিনিই সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। ১২৭ উইকেটের মালিক বাংলাদেশ অধিনায়ক। এদিন সাকিব ৪ ওভারে ৩৩ রানে নিয়েছেন ২ উইকেট।
তখনও অপ্রতিরোধ্য বিরাট কোহলি। দুঃসময়টা যে পেছনে ফেলে এসেছেন সেটি আরও একবার বুঝিয়ে তুলে নেন হাফ সেঞ্চুরি। এবারের বিশ্বকাপে দুইশর বেশি রান তুলে শীর্ষে এখন তিনিই। খেললেন ৪৪ বলে হার না মানা ৬৪ রানের ইনিংস। ৬ বলে ১৩ রবিচন্দ্রন অশ্বিনের। ভারত উঠে যায় চূড়ায়, ১৮৪! হাসান ৪ ওভারে ৪৭ রানে নেন ৩ উইকেট। সৌম্য সরকারের জায়গায় ফেরা শরিফুল ইসলাম ছিলেন সবচেয়ে খরুচে, ৪ ওভারে কোন উইকেট না নিয়ে দেন ৫৭ রান!
সুখস্মৃতির মাঠে ইতিহাসটা বাংলাদেশকে মনে করিয়ে দিল ভারত। টি-টোয়েন্টির দ্বৈরথে এর আগে ১২ লড়াইয়ের ১১টিতেই হার ছিল বাংলাদেশের। তবে আজ দিনশেষে মনে হচ্ছে অনাহুত বৃষ্টিতেই হয়েছে সর্বনাশ! না হলে ভারত বধের গল্পটাও লেখা হয়ে যেতে পারত অ্যাডিলেড ওভালে। যেখানে রূপকথার গল্প লেখার কথা সেখানে বৃষ্টি শেষে কাঁদল বাংলাদেশ!
এই ম্যাচ থেকে পাওয়া গেল দুটি জিনিস- এক, লিটন দাসের রুদ্ররূপ দুই, লড়াইয়ের আত্মবিশ্বাস, যেটি কাজে লাগতে পারে শেষ ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে। এই বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল এখনো কেউই নিশ্চিত করতে পারেনি। সমীকরণ এখনো অনেক পেছানো অবস্থায় আছে। আছে এবারের আসরের ত্রয়োদশ খেলোয়াড় ‘বৃষ্টি’ও! পাকিস্তান ম্যাচ তাই কী সমীকরণ সামনে রেখে খেলতে নামবে টাইগাররা তা পরিষ্কার নয়। সমীকরণ যাই হোক, ‘বিগ ম্যাচ’ জেতার সামর্থ্য আছে- সেটি আজ বোঝা গেছে।