সুনামগঞ্জের বাণিজ্যিক উপজেলা তাহিরপুরের সীমান্তে কয়লা কুঁড়িয়ে সংসারের হাল ধরেছেন হাজারও নিন্ম আয়ের পরিবার। পাহাড়ি ছড়া দিয়ে ঢলের পানিতে ভেসে আসা এসব কয়লা দিনভর তুললেও ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না শ্রমিকরা। এসব কয়লা বিক্রিতে প্রশাসনের বাধার কারণে ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে প্রশাসন বলছে, বিএমডির অনুমতি ছাড়া কয়লা উত্তোলণ ও বিক্রি নিষিদ্ধ। দ্রæত ইজারার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা হবে।
তাহিরপুর উপজেলার উত্তরশ্রীপুর ইউনিয়নের সীমান্ত গ্রাম রুংগার বাসিন্দা জয়গন। স্বামী মারা গেছেন ২৫ বছর আগে। দুই সন্তানের একছেলে ঢাকায় গামের্ন্টসে কাজ করেন। আরেক ছেলে এলাকায় দিন মজুরের কাজ করেন। জয়গনের মোট ৬ জনের সংসারে অভাব- অনটন লেগেই থাকে। তাই বৃদ্ধ বয়সেও ছড়ার টান্ডা পানিতে নেমে প্রতিদিন ৯ ঘন্টা কাজ করেন। এতেও সংসার চলে না তার। কারণ তার তুলা কয়লার ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না তিনি।
জয়গন বললেন, মেঘ বৃষ্টি এলে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে ভেসে কয়লা আসে। সেজন্য ছড়াতে সকাল ৭ টায় এসে কাজ করে বিকালে বাড়ি ফিরি। সারাদিন কাজ করে সর্বোচ্চ ২ বস্তা তুলতে পারি। প্রতিবস্তা ১০০ টাকায় বিক্রি করি। এই কয়লার বস্তাই আমাদের থেকে কিনে বিক্রি হয় সাত থেকে আটশ’ টাকা ধরে। আর আমরা বিক্রি করার সময় দাম পাই না। বাধ্য হয়েই কমদামে বিক্রি করি।
বাগলি গ্রামের বাসিন্দা সাহেরা বেগম বললেন, অন্য দিক দিয়ে কয়লা চারশ টাকার উপরে বস্তা বিক্রি হয়। আমরা মাত্র একশ টাকা ধরে বিক্রি করতে হয়। না তুলেও পারি না। সংসার তো চালাতে হবে। কোনো রকম ছেলে-মেয়ে নিয়ে জীবন বাঁচাই।
বিরেন্দ্রনগর গ্রামের বাসিন্দা আহাতুন খাতুন বললেন, সারাদিন জাল দিয়ে ছড়ায় কয়লা তুলি। পরে ক্রেতা পাই না। তাই দিনশেষে একশ’ টাকা ধরে প্রতি বস্তা কয়লা বিক্রি করি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ত্রিশ বছর ধরে ভারতের মেঘালয় থেকে ঢলের সঙ্গে ভেসে আসা ভাসমান কয়লা কুঁড়িয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছেন তাহিরপুরের সীমান্ত এলাকার হাজারও নি¤œ আয়ের মানুষ। তবে গেল কয়েক বছর ধরে প্রশাসনের বাঁধার মুখে বন্ধ রয়েছে এই কয়লা বিক্রি। এতে বিপাকে পড়েছেন এসব মানুষ। তবে প্রশাসন বলছে, বিএমডির অনুমতি ছাড়া কেউ কয়লা বা পাথর উত্তোলন করতে পারবে না। সীমান্ত এলাকায় কয়লা, পাথর তুলার অনুমতি দেয় নি বিএমডি। তবুও মানবিক কারণে শ্রমিকদের কয়লা তুলতে বাঁধা দেয়া হয় না। তবে দ্রæত ইজারার মাধ্যমে ছড়া ও নদী থেকে কয়লা উত্তোলনের সুযোগ করে দেয়া হবে।
রংগারছড়া গ্রামের বাসিন্দা মোছা. সুফিয়া আক্তার বললেন, কোদাল, জাল দিয়ে প্রতিদিন এক থেকে দুই বস্তা কয়লা তুলি। ঠিকমতো বিক্রি করতে পারি না। বন্যায় বাড়িঘর ভেঙে গেছে। সরকার নদীর মাঝে কয়লা না তুলতে দিয়ে পরিবার নিয়ে চলতে পারবো না। আমরা কাজ করে খেতে চাই। এজন্য সরকার আমাদের কয়লা তুলতে বাঁধা যেনো না দেয় সেটাই চাই।
একই গ্রামের বাসিন্দা হালিমা খাতুন বললেন, আমরা গরীব মানুষ। খেয়ে না খেয়ে দিন যায়। পাহাড়ি ঢলে যে কয়লা আসে তা নদী থেকে প্রতিদিন কষ্ট করে তুলি। প্রতিদিন এক থেকে দু’বস্তা তুলতে পারি। তাও কেউ কিনতে চায় না। প্রশাসনে তুলতে দেয় না। ‘কয়লা তুলতাম আর ধরে (ন্যায্য দাম) বেচতাম। ঝি- পুতাইন লইয়া খাইতাম। সরকার আমাদের জন্য এই টুকু করে দিবে চাওয়া আমাদের।’
উত্তরশ্রীপুর ইউনিয়নের বাগলি এক নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শাহজাহান খন্দকার বললেন, প্রতিবছর পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে সীমান্ত ছড়া দিয়ে কয়লা আসে। সেগুলো এলাকার নি¤œ আয়ের মানুষ তুলে বিক্রি করে। আমাদের এলাকার নি¤œ আয়ের মানুষ সেগুলো জাল দিয়ে তুলে বিক্রি করে। তবে এখন তুলতে পারলেও বিক্রি করতে পারছেন না। আমরা চাই এলাকার গবীর মানুষ এখানে কাজ করে যাতে পরিবার চালাতে পারে সেজন্য প্রশাসন প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বললেন, যারা কয়লা তুলেন তারা খুবই দরিদ্র মানুষ। কোনো কাজ নেই। সারাদিন রোদ্রের মধ্যে মশারির মতো এক ধরনের জাল দিয়ে পানি থেকে কয়লা তুলে। পরে এক জায়গায় করে বিক্রি করে। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি সারাদিনে চার থেকে পাঁচশ টাকার কয়লা বিক্রি করতে পারে তারা। যেহেতু একবারেই খেটে খাওয়া মানুষ তাই মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদের বিরুদ্ধে ভ্রামমাণ আদালত পরিচালনা করি না। গত জুনের ১৬ তারিখে সুনামগঞ্জের মানুষের বড় বিপর্যয় হয়ে গেছে। মানুষ কর্মহীন রয়েছে। সেকারণে আমরা আপাতত তাদের নিষেধ করছি না। তবে পরিবর্তীতে কঠোর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবো। কাউকে এসব এলাকা থেকে কয়লা তুলতে দেবো না। যখন বিএমডি অনুমোদন দিবে তখন তারা বৈধভাবে ইজারার মাধ্যমে এই কয়লা তুলে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে।