মঙ্গলবার , ৩ আগস্ট ২০২১ | ১৩ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অপরাধ
  2. অর্থনীতি
  3. অস্ট্রেলিয়া
  4. আন্তর্জাতিক
  5. আফ্রিকা
  6. আবহাওয়া
  7. আমেরিকা
  8. আয়ারল্যান্ড
  9. ইউক্রেন
  10. ইউরোপ
  11. ইতালি
  12. কানাডা
  13. খেলাধুলা
  14. গ্রাম বাংলা
  15. চিত্র বিচিত্র

করোনাকালে নারী নির্যাতন বাড়ছে কেন

প্রতিবেদক
Probashbd News
আগস্ট ৩, ২০২১ ৭:৫৪ পূর্বাহ্ণ
করোনাকালে নারী নির্যাতন বাড়ছে কেন

Spread the love

চপল বাশার 

দেশে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে করোনাকালে অর্থাৎ গত বছরের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের নারী নির্যাতনের ঊর্ধ্বগতি উদ্বেগজনক। মানবতাবিরোধী এ অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।

শীর্ষস্থানীয় নারী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ১৩টি বাংলা ও ইংরেজি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে সারা দেশে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের তথ্য সংরক্ষণ করে। সংরক্ষিত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, হত্যাসহ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের মতো বিভিন্ন অপরাধের সংখ্যা ছিল ১৪৫১। চলতি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ১৭৯৪টি। এ হিসাবে বৃদ্ধির হার প্রায় ২৪ শতাংশ।

জাতীয় দৈনিকগুলোয় নারী নির্যাতন সম্পর্কিত যত খবর প্রকাশিত হয়েছে, সেটাই সব নয়। প্রকৃত সংখ্যা অবশ্যই অনেক বেশি। সংবাদপত্রে সব খবর আসে না অনেক কারণে। ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, যৌন নিপীড়ন, উত্ত্যক্তকরণের মতো অনেক ঘটনা থানায় রিপোর্ট হয় না। মামলাও হয় না। নির্যাতিত নারী বা কন্যাশিশুর অনেক অভিভাবক পুলিশের কাছে যান না। তারা এই ভেবে ভয় পান যে, ঘটনা প্রচারিত হলে নির্যাতিত মেয়েটি সমাজের কাছে হেয় হবে অথবা আরও বেশি লাঞ্ছিত হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নির্যাতনকারী বা অপরাধী প্রভাবশালী হয় অথবা প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থাকে। তাই নির্যাতিত নারীকে মামলা করতে দেওয়া হয় না, মামলা করলেও তা ধাপাচাপা দেওয়ার ব্যবস্থা হয়।

জাতীয় দৈনিকগুলোর সংবাদদাতা থাকেন দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত। তারাই তাদের পত্রিকায় নারী নির্যাতন এবং এ ধরনের অপরাধের খবর পাঠান। অনেক সময় তারা এসব খবর পান না, পেলেও থানায় মামলা না হওয়া পর্যন্ত পত্রিকায় খবর পাঠাতে তাদের সীমাবদ্ধতা থাকে। প্রভাবশালী মহলের চাপও থাকে তাদের ওপর। এসবকিছু বিবেচনা করেই বলা যায়, সংবাদপত্রে নারী নির্যাতনের যত খবর প্রকাশিত হয়, তা প্রকৃত পরিস্থিতির প্রতিফলন নয়। নারী নির্যাতনের ঘটনা আসলে অনেক বেশি ঘটছে।

তা সত্ত্বেও এ কথা মানতেই হবে, মহিলা পরিষদ ১৩টি জাতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে নারী নির্যাতনের যে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছে, তা উদ্বেগজনক পরিস্থিতির প্রমাণ। এ জরিপে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের মোট ৩৮ ধরন চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা, শ্লীলতাহানি, যৌন নিপীড়ন, অ্যাসিড নিক্ষেপ, অপহরণ, নারী পাচার, যৌতুকের কারণে নির্যাতন, উত্ত্যক্তকরণ ইত্যাদি।

মহিলা পরিষদের জরিপে দেখা যায়, গত বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নারী নির্যাতন সম্পর্কিত মোট ৩৪৪০টি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনাই সর্বোচ্চ, ১০৭৪টি। গণধর্ষণের ২৩৬টি ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৩৩ নারীকে। ধর্ষণচেষ্টার ২০০ খবর পাওয়া গেছে। শ্লীলতাহানি ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ১১৭ জন। অপহরণ করা হয়েছে ১২৫ নারীকে। নারী ও শিশু পাচারের ঘটনা ৯৭টি। গত বছর ৪৬৮ নারীকে হত্যা করা হয়, রহস্যজনক মৃত্যু হয় ২৫২ জনের।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে নারী নির্যাতনের ১৭৯৪টি ঘটনা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ৫৭২, গণধর্ষণ ১০৫, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১৬ জনকে। শ্লীলতাহানি ও যৌন নিপীড়ন হয়েছে ৫৯টি। ছয় মাসে সারা দেশে হত্যা করা হয়েছে ২২১ জন নারীকে। রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে ২২৫ জনের। অপহরণ করা হয় ৯৫ জনকে। যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয় ৩০ জনকে, নির্যাতিত হন ৪৪ জন।

এ বছর ছয় মাসে নারী-কন্যাশিশু নির্যাতনের যত ঘটনা ঘটেছে, তা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। অপরাধের ঊর্ধ্বমুখী ধারা থেকে আশঙ্কা হয় এ বছরের মোট ঘটনা গত বছরের চেয়ে বেশি হবে।

দেশে নারী নির্যাতন আগেও ছিল। গত বছর হঠাৎ তা বেড়ে গেছে, এ বছরও ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু এ অপরাধ বাড়ছে কেন? বিশেষ করে করোনাকালের এ দুঃসময়ে? গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এরপর করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে দ্রুতগতিতে এবং ওই মাস থেকেই করোনায় মৃত্যু ঘটতে থাকে। ১৭ মার্চ সরকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয় এবং পরে লকডাউনের মতো বিধিনিষেধ আরোপ করতে থাকে সংক্রমণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও করোনা মহামারির বিরূপ প্রভাব পড়েছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কর্মহীন হয়েছে কয়েক কোটি মানুষ। স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় কার্যত অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর ১৬ মাস পার হয়ে গেছে। মহামারি থেমে যায়নি, বরং বাড়ছে। ইতোমধ্যেই ২০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। সংক্রমিত হয়েছেন এ পর্যন্ত ১২ লাখের বেশি।

সামগ্রিক পরিস্থিতির কারণে সমাজও স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। মানুষে মানুষে, পরিবারে পরিবারে, বিচ্ছিন্নতা ও দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে যেতে পারছে না-কবে যেতে পারবে, তার নিশ্চয়তা নেই।

এখন চলছে ‘কঠোর লকডাউন’। অফিস-আদালত, দোকানপাট, গণপরিবহণ সব বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। মানুষ ঘরবন্দি। সংক্রমণের বিস্তার রোধ করে মহামারিকে নিয়ন্ত্রণে আনাই উদ্দেশ্য।

দীর্ঘদিন ধরে চলমান করোনা পরিস্থিতি সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। অপরাধপ্রবণতা বেড়ে গেছে সর্বক্ষেত্রে। নারী নির্যাতনের মতো অপরাধও সে কারণেই বাড়ছে। শহর থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত বহু মানুষের মধ্যে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ লক্ষ করা যায়। তথাকথিত ‘কিশোর গ্যাং’-এর কথা এখানে উল্লেখযোগ্য। উচ্ছৃঙ্খল কিছু কিশোর-তরুণ দলবদ্ধভাবে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এ ধরনের কিশোর গ্যাং ঢাকা শহর এবং অন্যান্য শহরাঞ্চলে সক্রিয়। এরা ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, এমনকি ধর্ষণের মতো অপরাধও করছে। সংবাদপত্রে এসব কিশোর গ্যাংয়ের অপকর্ম সম্পর্কে রিপোর্ট ছাপা হচ্ছে, এদের নাম-পরিচয়ও কাগজে এসেছে। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা পুলিশ নিয়েছে বলে জানি না। ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় এদের উৎপাত বেড়েছে।

এ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের একটি অংশ কর্মহীন তরুণ-যুবক, অথবা ছাত্র-যাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এদের কিছু করার নেই। তাই অপকর্ম করছে। এদের ওপর অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণ নেই, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষও নির্বিকার।

অব্যাহত নারী নির্যাতন সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন। নারী নির্যাতনকে অনেকে অপরাধ বলেই মনে করে না, এটা তাদের জন্য আনন্দের বিষয়। এ ধরনের ঘটনা প্রমাণ করে আমাদের সমাজ অনেক পিছিয়ে আছে। পুরোপুরি সভ্য এখনো হয়নি।

নারী নির্যাতন কেন বাড়ছে এবং এ অপরাধ বন্ধ করতে কী করণীয়? এ সম্পর্কে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম মনে করেন, নারী নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘন, এটি সবাইকে বুঝতে হবে। এ মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব সমাজ ও সরকার উভয়ের। নারী নির্যাতন বন্ধের ক্ষেত্রে বিচারহীনতা বড় অন্তরায়। পরিস্থিতির কারণে নির্যাতনের শিকার নারীদের মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ আইনের আশ্রয় নেয়, বিচারপ্রার্থী হয়। বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে চার শতাংশের কম নারী বিচার পায়। নারী নির্যাতন রোধ করতে প্রথমেই প্রয়োজন অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করা।

নারী নির্যাতনের বিচারের জন্য কঠোর আইন রয়েছে। ধর্ষণের অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান হয়েছে। কিন্তু আইন তো সঠিকভাবে প্রয়োগ হয় না। তাই আইন এক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে আছে। অতএব কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করে নারী নির্যাতনের বিচার নিশ্চিত করলেই এ ধরনের অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব।

চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক

সর্বশেষ - প্রবাস