একটি সংক্রামক ব্যাধি কীভাবে গোটা বিশ্বে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিপর্যয় ঘটাতে পারে, তা এ মুহূর্তে আমরা প্রত্যক্ষ করছি। করোনার বৈশ্বিক মহামারি বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশকে বিগত দুই বছরে যে ভয়াবহ বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য করেছে, তার শিকার হয়েছে দেশগুলোর অর্থ ও শ্রমবাজারসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ খাত, যা সাধারণ সময়ে রাষ্ট্রগুলোর প্রবৃদ্ধির গতিময়তাকে ধরে রাখে।
অতিমারির এমন প্রভাবের যেসব ক্ষতি অর্থের অঙ্কে অনুমান করা সম্ভব, সেসব ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার প্রয়াস আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, করোনা মহামারি আমাদের মধ্যে মানসিক ভীতি, যোগাযোগ শঙ্কা, ধারাবাহিক শিক্ষা প্রক্রিয়ার ব্যাঘাতসহ নানা সমস্যা ও বৈষম্যের রেশ রেখে যাচ্ছে, যেগুলোর ব্যাপ্তি বা প্রভাব কোনো অর্থেই কম নয় এবং এসব সমস্যার সমাধান ও বৈষম্য দূর করতে প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ। আর্থিক মানদণ্ডে যেসব ক্ষতিকে অপূরণীয় হিসাবে তাৎক্ষণিকভাবে সামনে আনা কঠিন, অথচ সামাজিক গুরুত্ব বিবেচনায় যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে এমন একটি প্রসঙ্গ হলো করোনাকালে দেশের প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা ও প্রযুক্তিগত বিকাশের স্থবিরতা।
দেশের যে কোনো শিক্ষিত ও সচেতন নাগরিককে আগামীর পৃথিবীর একটি আনুমানিক চিত্র আঁকতে বলা হলে নিঃসন্দেহে তিনি এর সহায়ক হিসাবে বেছে নেবেন ডিজিটাল প্রযুক্তির সম্ভাবনাময় সব উপকরণকে। ফাইভজি প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), ক্লাউডসহ অসংখ্য ভবিষ্যৎমুখী প্রযুক্তি উপাদান বর্তমানে বিশ্বের মানুষকে ভবিষ্যতের সমাজ ও জীবনযাত্রার একটি রূপরেখার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু যারা এ প্রযুক্তিভিত্তিক রূপান্তরের প্রাথমিক ধারণা বা ভিত্তিমূলের সঙ্গেই এখনো পুরোপুরি মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়নি, কিংবা এর সুযোগই পায়নি, তাদের কী হবে?
আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ আর্থিক সচ্ছলতা ও সামাজিক শ্রেণির বিচারে এখনো পিছিয়ে রয়েছে, যাদের আয়ের সিংহভাগ চলে যায় কেবল অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রতিযোগিতায়। আজন্ম দারিদ্র্যের শেকলে আবদ্ধ এ পরিবারগুলোতে যে শিশুরা জন্ম নেয়, তারাও খুব দ্রুতই তাদের চারপাশের কঠিন বাস্তবতাকে চিনতে শেখে। তাদের অধিকাংশের জীবনেই শৈশব বা কৈশোরের গণ্ডি পেরোনোর আগে কায়িক শ্রমের বিনিময়ে পরিবারের জন্য একটি আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়ানোর তাড়না সৃষ্টি হয়। ফলে তাদের হারাতে হয় স্বাভাবিক শিক্ষার সুযোগ। সেই সঙ্গে হারিয়ে যায় তাদের সুস্থ মানসিক বিকাশের সম্ভাবনা।
বর্তমানে দেশে সুবিধাবঞ্চিত শিশুর সংখ্যা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও ইউনিসেফ ও অন্যান্য সংস্থার অতীতের জরিপভিত্তিক তথ্য থেকে অনুমান করা যায়, সংখ্যাটি ১০ লাখের কম নয়। এ ১০ লক্ষাধিক শিশু করোনাকালে কেমন আছে, মহামারি পরবর্তীকালে তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের নিশ্চয়তা কেমন সে প্রসঙ্গে এখন ভাবার সময় এসেছে। একটি প্রযুক্তিনির্ভর আগামীর জন্য তাদের প্রস্তুত করে তোলার দায়িত্ব আমাদেরই গ্রহণ করতে হবে, কারণ তাদের মধ্যে যে সম্ভাবনা ও প্রতিভা সুপ্ত রয়েছে, সেটিকে পুঁজি করেই আগামীতে আমাদের সমাজব্যবস্থার চিত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪০ ভাগ শিশু, যাদের ১৫ শতাংশেরও বেশি দরিদ্র শ্রেণিভুক্ত। যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন সামনে রেখে আমরা জাতিগতভাবে এগিয়ে চলেছি, তার যথার্থ বাস্তবায়ন করতে গেলে এ উপেক্ষিত জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরের বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে অনুস্বাক্ষর করেছে। এর ধারাবাহিকতায় প্রান্তিক শ্রেণিভুক্ত ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সুরক্ষাকে কেন্দ্র করে ‘প্রটেকশন অব চিলড্রেন অ্যাট রিস্ক’ এবং ‘সার্ভিসেস ফর দ্য চিলড্রেন অ্যাট রিস্ক’-এর মতো বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা। পাশাপাশি, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও এ লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। তবে পরিস্থিতির তুলনায় এর প্রতুলতা নিয়ে এখনো কিছুটা সংশয় রয়েছে; বিশেষত, এ শিশুদের ডিজিটাল শিক্ষা ও প্রযুক্তিগত ধারণার বিকাশ প্রসঙ্গে গৃহীত পদক্ষেপের সংখ্যা এখনো হাতেগোনাই বলা চলে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) তথ্যানুযায়ী, কেবল ঢাকা শহরেই পথশিশুর সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লাখ। দেশের আনাচে-কানাচে এমনভাবে ছড়িয়ে আছে আরও অসংখ্য শিশু। করোনাকালে এ শিশুদের সাধারণ মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ নিয়েই যেখানে সংকটাপন্ন অবস্থা তৈরি হয়েছে, সেখানে তাদের হাতে ডিজিটাল শিক্ষার উপকরণ তুলে দেওয়া বা তাদের জীবনে প্রযুক্তিভিত্তিক উন্নয়নের আশা করা কঠিন। কিন্তু গোটা বিশ্ব যখন করোনা-পরবর্তী বিশ্বের প্রস্তুতির অন্যতম অংশ হিসাবে ডিজিটাল প্রযুক্তির পরিচিতি ও প্রসারে জোর দিচ্ছে, তখন এ কঠিন কাজটিকেই আবশ্যকীয় বলে বিবেচনার প্রয়োজনীয়তা আমাদের সামনে তৈরি হয়েছে।
দীর্ঘ সময় বন্ধ ছিল দেশের স্কুল-কলেজগুলো। এ সময় তারা ডিজিটাল ক্লাসরুম ও অনলাইন শিক্ষাদান প্রক্রিয়ার ওপর জোর দিয়েছে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে অজস্র তথ্যের ভাণ্ডার। পকেটের ছোট্ট স্মার্টফোনেই এখন বহন করা যায় হাজার হাজার বইয়ের ডিজিটাল লাইব্রেরি। এমন সুবিধা থেকে প্রান্তিক শিশুরা বঞ্চিত থাকার কারণে যে ডিজিটাল ডিভাইড বা প্রযুক্তিগত বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ হয়তো জাতি হিসাবে একসময় আমাদের জন্য অকল্পনীয় হতে পারে।
আসন্ন চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে উন্নত দেশগুলোয় যেসব পরিকল্পনা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তার কেন্দ্রেও রয়েছে প্রযুক্তিগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আভাস। জাতি হিসাবে এ দৌড়ে পিছিয়ে পড়তে না চাইলে দেশের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে প্রযুক্তির বলয়ে অন্তর্ভুক্ত করা বা ডিজিটাল ইনক্লুশনের আওতায় আনা এখন আমাদের সময়ের দাবি। এ দাবি আদায় নিশ্চিত করতে দেশের ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারের সঙ্গে একত্রে কাজ করার নিঃশর্ত মানসিকতা গঠন করতে হবে। ইতোমধ্যেই কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যার কেন্দ্রে রয়েছে সুবিধাবঞ্চিত শিশুর ভবিষ্যৎমুখী বিকাশ ও প্রস্তুতি নিশ্চিতকরণ।
বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুসারে, করোনাকালে বাংলাদেশের শতকরা মাত্র ৯.২ ভাগ দারিদ্র্যপীড়িত শিক্ষার্থী শিশুর হাতে ডিজিটাল ক্লাসরুমে সংযুক্ত হওয়ার মতো পর্যাপ্ত সুবিধা বা সরঞ্জাম ছিল। এ সংখ্যাটিকে বৃদ্ধি করতে সম্প্রতি হুয়াওয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য ল্যাপটপ, ট্যাব, রাউটার, ইন্টারনেট সাবস্ক্রিপশনসহ বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা সরঞ্জাম অনুদানের উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। অতীতেও প্রতিষ্ঠানটি ‘আইসিটি বাসে’র মতো উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের গুরুত্বকে তুলে ধরেছিল।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বিবেচনায় যে অনলাইন এডুকেশন মার্কেট আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ৩৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তার জন্য যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে চাইলে দেশের অন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও একইভাবে এগিয়ে আসতে হবে। ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রযুক্তিভিত্তিক অগ্রযাত্রায় গুরুত্বারোপ করার এটিই উপযুক্ত সময়। করোনা মহামারির ফলে উদ্ভূত কঠিন বাস্তবতাকে মোকাবিলা করতে এখন আমাদের প্রয়োজন সর্বক্ষেত্রে সমন্বিত পরিকল্পনা ও সহযোগিতার মানসিকতা। অন্যথায়, করোনা-পরবর্তী ভবিষ্যতে হয়তো এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমাদের প্রয়োজনের চেয়েও কয়েক যুগ বেশি সময় লেগে যেতে পারে।
আহমেদ ইমতিয়াজ জামি : প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, অভিযাত্রিক ফাউন্ডেশন