বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের জন্য মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে নতুন করে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরের প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছেন দেশটির নতুন মানবসম্পদমন্ত্রী ভি. শিবাকুমার।
মঙ্গলবার (২০ ডিসেম্বর) কুয়ালালামপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান।
মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়া থেকে কর্মী নিয়োগের জন্য পূর্বসূরির যেই সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) চুক্তি রয়েছে সেটিই আপাতত বলবৎ থাকবে। এটি নতুন করে পর্যালোচনা করারও কোনো পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের নেই।
গত ডিসেম্বরে, আগের মানবসম্পদমন্ত্রী এম. সারাভানান দেশে শ্রম ঘাটতি দূর করতে বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে একটি বিদেশি কর্মী সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেন।
অভিবাসী শ্রমিকদের প্রবেশ ত্বরান্বিত করার জন্য সরকারের প্রচেষ্টা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, শিবকুমার বলেছেন, তার মন্ত্রণালয় শ্রমের ক্রমবর্ধমান চাহিদা উল্লেখ করেছে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিষয়টি সমাধান করবে।
কিছু পরিবর্তন আছে যা শিগগিরই ঘোষণা করা হবে। এছাড়া কীভাবে প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করা যায় তার সমাধান খুঁজতে আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি।
মন্ত্রী আশা করছেন, নতুন সেট আপের আগের চেয়ে দ্রুত হবে এবং এটি কীভাবে সেট আপ করা হবে তা চূড়ান্ত করার পরে খুব শিগগিরই বিস্তারিত জানাবেন বলে মন্ত্রী যোগ করেন।
গত সপ্তাহে, মানব সম্পদমন্ত্রী শিবকুমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, চলমান শ্রমের ঘাটতি মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রধান অগ্রাধিকার হবে। ৪৬৬ নিয়োগকর্তার মোট ৭৫ হাজার ৭৫১টি আবেদনের মধ্যে ৬৭,৯৫৮টি ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুমোদিত হয়েছে।
শিবকুমার বলেছেন, ভবিষ্যতে ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে কর্মীদের জন্য সমাধান খুঁজতে শিল্প মালিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবেন এবং কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ (টিভিসিইটি), প্রতিভা ব্যবস্থাপনা এবং বিকাশের পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষার বিকাশের দিকেও মনোনিবেশ করবেন।
এদিকে মালয়েশিয়ায় নতুন করে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত ১ লাখ ৭৫ হাজার চাহিদাপত্রের আবেদন পেয়েছে মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং ১ লাখ ৫০ হাজার ছাড়পত্র দিয়েছে। এর বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩৫ হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় কর্মক্ষেত্রে যোগদান করেছেন বলে মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্রে জানা গেছে।
অথচ চলতি বছরে মালয়েশিয়ায় প্রায় লক্ষাধিক কর্মী পাঠিয়েছে নেপাল, যারা বাংলাদেশের কর্মীদের তুলনায় অর্ধেক খরচে গেছে। একটি সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়া যেতে বাংলাদেশ প্রান্তে অভিবাসন ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৯ হাজার টাকা। সেখানে কর্মীদের ন্যূনতম মাসিক বেতন হবে ১ হাজার ৫০০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত। তবে বাস্তবে মালয়েশিয়ায় যেতে শ্রমিকদের প্রায় সাড়ে ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা খরচ করতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর বাংলাদেশের জনশক্তি খাতের ব্যবসায়ীরা ব্যস্ত ছিলেন সিন্ডিকেট নিয়ে। ফলে খরচ বেড়ে গেছে। ওদিকে একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার পাশাপাশি মালয়েশিয়ায় নানা তদবিরে ব্যস্ত ছিলেন তারা। এই ফাঁকে জনশক্তি পাঠানোর গতি হয়ে যায় শ্লথ। ফলে এই বাজারে অন্যদেশের কর্মীরা ঢুকে পড়ে।
বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার বিষয়ে যা বললেন নতুন মানবসম্পদমন্ত্রী
মালয়েশিয়ায় থাকা প্রবাসীরা বলছেন, দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারটি বাংলাদেশের জন্য উন্মুক্ত হয়েছিল। কিন্তু সেই চমৎকার সুযোগটি নেওয়া যাচ্ছে না শুধু দুর্বৃত্তায়নের কারণে। সরকার কর্মী পাঠাতে ব্যর্থ হচ্ছে।
কর্মী না পাঠাতে পারার অন্যতম কারণ সিন্ডিকেট ও অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়ের কথা উল্লেখ করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রবাসী বলেন, এই মুহূর্তে মালয়েশিয়ায় অন্তত ১৫ লাখ কর্মীর প্রয়োজন। বাংলাদেশ কর্মী পাঠাতে পারছে না বলে তো কোম্পানিগুলো বসে থাকবে না। তারা বিভিন্ন সোর্স থেকে কর্মী সংগ্রহ করছে।
মালয়েশিয়া প্রবাসী সাইদুল ইসলাম বলেন, নেপাল মাত্র ৭ থেকে ৮ হাজার রিঙ্গিতে (১ লাখ ৭৫ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা) মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশি কর্মীদের আসতে খরচ হচ্ছে এর দ্বিগুণ। এজন্য রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো পুরোপুরি দায়ী। তাদের উচ্চ মুনাফার মানসিকতার জন্যই মালয়েশিয়ার বাজার হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এছাড়া ‘নিয়োগের অনুমতি পাওয়ার পরও কর্মী যেতে ৩ থেকে ৪ মাস সময় লেগে যায়।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে কর্মী পাঠানোর বিষয়ে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়। এমওইউ অনুযায়ী, বৃক্ষরোপণ, কৃষি, উৎপাদন, পরিষেবা, খনি, নির্মাণ এবং গৃহস্থালি পরিষেবাসহ সব খাতে ৫ বছরে ৫ লাখ কর্মী নেবে মালয়েশিয়া।
গত ৮ আগস্ট বাংলাদেশ থেকে প্রথম দফায় ৫৩ জন কর্মী মালয়েশিয়ায় প্রবেশের মাধ্যমে এ পর্যন্ত মাত্র ৩৫ হাজার কর্মী দেশটিতে গেছে। মালয়েশিয়ায় কর্মীর অভাবে বহু প্রতিষ্ঠান অচল।
জানা গেছে, মালয়েশিয়া নেপাল বা অন্যান্য দেশ থেকে কর্মী নিলেও সেখানকার কোম্পানিগুলোর কাছে বাংলাদেশি কর্মীদের চাহিদা ব্যাপক। তাই বিকল্প পথে ১০ হাজার বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের নতুন প্রক্রিয়াও শুরু করেছে মালয়েশিয়া।
এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ওভারসিজ এম্পলয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের (বোয়েসল) মাধ্যমে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট (জি-টু-জি) সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী কর্মী নিয়োগের জন্য এই এককালীন একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
এজন্য কর্মীদের কোনো টাকা দিতে হবে না। বলা যায় শূন্য অভিবাসন খরচে এসব কর্মী নিচ্ছে মালয়েশিয়া। গত ২৯ নভেম্বর সরকারিভাবে মালয়েশিয়ায় ৩০ বাংলাদেশি কর্মীর প্রবেশের মাধ্যমে শুরু হয় এ প্রক্রিয়া।
২০১৮ সালে বন্ধের আগে সে বছর প্রায় পৌনে ২ লাখ কর্মী দেশটিতে যায়। ১৯৯২ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বৈধভাবে মালয়েশিয়া গেছেন সাড়ে ১০ লাখ বাংলাদেশি কর্মী।