সব গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া প্রচলন করতে জাতীয় সংসদে আইন পাস করার দাবি জানিয়েছেন বিএনপির সাংসদ রুমিন ফারহানা। আজ শনিবার জাতীয় সংসদে ‘মহাসড়ক বিল ২০২১’ পাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে এ দাবি জানান তিনি।
এদিকে বিলের আলোচনায় জাতীয় সংসদে উঠে আসে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বর্জ্যবাহী গাড়িতে দুজনের মৃত্যু, বাসে হাফ ভাড়া, নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ। সদস্যদের ক্ষোভ ও সমালোচনার মুখে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘চেয়ারে বসলে কিছু বিষয় অ্যাডজাস্ট করতে হয়।’
রুমিন ফারহানা বলেন, সরকার বলে, বেসরকারি গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের নেই। কথাটি সঠিক বা সত্য নয়। কারণ, সরকার যদি ব্যবসার জন্য কোনো আইন করে, সেটা মেনে নিয়ে ব্যবসা করতে হয় ব্যবসায়ীদের। সরকার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ও বেসরকারি পরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার আইন করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সবাইকে সেটা মানতে হবে। শুধু শহর এলাকার বাসে নয়, সব গণপরিবহনে অবলিম্বে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া দিয়ে যাতায়াতের আইনি বিধান করা হোক।
রুমিন বলেন, সম্প্রতি বাস ভাড়া বাড়ানোর পর মালিকপক্ষ হাফ ভাড়া বন্ধ করে দিয়েছে। এর জেরে শিক্ষার্থীরা পথে নেমেছেন। কিন্তু তাঁদের ওপর ছাত্রলীগ, যুবলীগের কর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তিন বছর আগে যখন আন্দোলন হয়েছিল, তখন হেলমেট পরে তাঁরা চেহারা লুকানোর চেষ্টা করেছিলেন। এবার যখন ঝাঁপিয়ে পড়লেন হেলমেট পরা ছিলেন না।
সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় শিক্ষার্থীসহ দুজন নিহত হওয়ার কথা তুলে ধরে রুমিন বলেন, ২০১৮ সালে শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর ছাত্ররা রাস্তায় নেমে এসেছিল। তখন সরকার পরিবহন আইন করে। কিন্তু পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের চাপে সংশোধন করে শাস্তি কমানো হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ চারটি ধারা স্থগিত রাখা হয়েছে, এসব ধারায় কোনো মামলা হয়নি। এটি ছাত্রদের সঙ্গে স্রেফ প্রতারণা।
মহাসড়ক তৈরিতে অতিরিক্ত ব্যয়ের সমালোচনা করে রুমিন ফারহানা বলেন, শুধু পাসের দেশ ভারত কিংবা চীন নয়, ইউরোপ আমেরিকার অনেক দেশের তুলনায় আমাদের দেশের সড়ক নির্মাণে বেশি ব্যয় হয়। সেই কারণে এ দেশের মহাসড়ক পৃথিবীর মহাসড়ক বলে মনে হয় না, ভিনগ্রহের হতে পারে। ঢাকা-ভাঙ্গা-মাওয়া মহাসড়কের কিলোমিটার প্রতি ব্যয় হয়েছে ২০০ কোটি টাকা; যা পৃথিবীতে নজিরবিহীন।
শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিয়ে রুমিনের বক্তব্যের জবাবে এ বিষয়ে সরকারের ইতিবাচক অবস্থান তুলে ধরলেও আইন করা নিয়ে কিছু বলেননি সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির আরেক সাংসদ হারুনুর রশীদ বলেন, শিক্ষার্থীরা হাফ ভাড়ার দাবিতে রাস্তায় নামার পর লাঠিসোঁটা নিয়ে ছাত্রলীগ চড়াও হলো। সরকারি দল মানেই লাঠিসোঁটা, গুন্ডাপান্ডা। যারা এ হামলা চালিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চান তিনি।
(নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠায়) সরকার কী করে, সেই প্রশ্ন রেখে জাতীয় পার্টির সাংসদ মুজিবুল হক বলেন, দুই দিনে দুজন নিহত হয়েছেন। সিটি করপোরেশনের চালক কেমন মাতবর, ১০ হাজার টাকা দিয়ে অন্য লোককে দিয়ে গাড়ি চালায়। সড়কে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেওয়ার দাবি জানান তিনি। এ সময় মুজিবুল হক পাশে বসা নিজ দলের সাংসদ মশিউর রহমানকে দেখিয়ে বলেন, ‘সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি বসে আছেন আমার পাশে। সভাপতি জাতীয় পার্টির, সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগের। শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি আওয়ামী লীগের, সেক্রেটারি কমিউনিস্ট পার্টির। কিছু বললে কী হয় ভয়ও করে।’
বিরোধী সাংসদদের বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বিআরটিসি বাসে হাফ ভাড়া চালু করা হয়েছে। এটা ১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে। সারা দেশেই বিআরটিসিতে হাফ ভাড়া করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, বেসরকারি গণপরিবহনের বিষয়ে কিছু জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। তারা সরকারের অধীন নয়, সরকারের সঙ্গে হয়তো কাজ করে। বেসরকারি গণপরিবহন বিষয়ে সিদ্ধান্ত তাদের নেওয়া দরকার। সামাজিক দায়বদ্ধতা ও জনস্বার্থ বিবেচনায় তাদের অনুরোধ করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকেও তাদের অনুরোধ করা হয়েছে। তাঁরা আশা করেন, ইতিবাচকভাবে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়া হবে।
ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ছাত্রলীগ বিবৃতি দিয়ে ছাত্রদের হাফ ভাড়ার পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে। যেখানে সাংগঠনিকভাবে তারা হাফ ভাড়ার পক্ষে, সেখানে তারা হামলা কেন করতে যাবে? ছাত্রলীগ হামলা করেছে, এটি সত্য নয়। ছাত্রলীগ নামধারী কোনো দুর্বৃত্ত এটা করতে পারে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘পরিষ্কারভাবে একটি সত্য কথা বলতে চাই। এখানে অনেক সমস্যা আছে। যখন চেয়ারে বসবেন, অনেক কিছু মোকাবিলা করতে হয়। একটা চ্যালেঞ্জিং জব। এখানে আমরা কিছু কিছু বিষয় অ্যাডজাস্ট করি।’
সড়ক পরিবহন আইন বিষয়ে রুমিনের উদ্দেশে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী বলেন, ‘সংসদে যেটা বলা হয়েছে, তা মোটেও ঠিক নয়। আপনি আইনটির সংশোধিত রূপটি এখনো দেখেননি। এটা সংসদে আসেনি। ওয়েবসাইটে আছে।’
ওবায়দুল কাদের বলেন, এই আইনে সাজার কঠোরতা কোনোভাবেই শিথিল করা হয়নি। কোনো সাজা কমানো হয়নি। আইনের যে কঠোরতা, যে স্পিরিট, অরিজিনাল আইনে যা ছিল, সেটাই আছে। সেটাই থাকবে। শুধু ভাষাগত ও প্রতিশব্দের বিষয় এবং প্রতিবেশী অন্যান্য দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইনটিকে যুগোপযোগী করা হয়েছে। সাজা কমিয়ে কাটছাঁট করে কারও সঙ্গে প্রতারণা করা হয়নি।
সড়ক দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ করা শুধু সরকারের কাজ নয়। সবার সহযোগিতা দরকার। সাধারণ মানুষ আইন মানলেও আপনি ভিআইপি হয়ে রং সাইডে যেতে চান। সেখানে কী সড়কের শৃঙ্খলা থাকবে? মা শিশুকে কোলে নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে আইল্যান্ড ক্রস করছেন। মুঠোফোন কানে দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন।
দুর্ঘটনা হবে না? এ জন্য কী শুধু চালকেরা দায়ী? বেপরোয়া ড্রাইভিং অবশ্যই দায়ী, আমি সেটা অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমরা জনগণ, যারা রাস্তা ব্যবহার করি, তারা সচেতন নই। শুধু চালক নয়, পথচারীরাও বেপরোয়া হয়ে যায়।’
পরে জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব ও সংশোধনগুলো নিষ্পত্তি শেষে ‘মহাসড়ক বিল ২০২১’ কণ্ঠভোটে পাস হয়।