ঘড়ির কাটায় ঠিক বিকাল ৫:০০ টা কিছুক্ষণ হলো বৃষ্টি থেমেছে। গেলো কয়টা দিন প্রচন্ড গরমে অতিষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম। প্রতিদিনই অফিসের পরে ওয়ালিদের বাড়ির ছাদে বসে বসে আড্ডা মারছি রাত দশটা – এগারোটা পর্যন্ত, দখিনা হওয়ায় শরীর জুড়িয়ে নেয়া সাথে মুফতে পাওয়া চা, বিস্কুট, পুড়ি , চানাচুর ভর্তা। পুরান ঢাকা’র এই এলাকাটা তখনো পর্যন্ত ইংরেজ সাহেবদের রেখে যাওয়া বনেদি ভাবটা ছিল। বেশ গোছানো পরিপাটি একটা আবাসিক এলাকা। ওয়ালিদের বাড়িটা ছিল ওয়ারির ৱ্যাঙ্কিন স্ট্রিট এর প্রায় শেষ মাথার ৭ নাম্বার বাড়িটা। দক্ষিণমুখী বাড়ি সামনে খোলা উঠোন, প্রশস্ত রাস্তা পেরিয়ে বুড়িগঙ্গার ঠান্ডা হাওয়া তাদের দো’তলার বাড়ির ছাদে এসে ঠিক ঠিক আছড়ে পড়ত । ঢাকার এই দিকটায় তখনো উঁচু ভবন বানানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়নি । কিছুটা সবুজ – কিছুটা প্রাণ তখনও বেঁচে ছিল।
১৯৮৯ – ৯০ দিকের কথা, বন্ধুরা সবাই যখন কলেজ-ইউনিভার্সিটি নিয়ে ব্যস্ত আমি তখন শিখছি বিদেশী কোনো কোম্পানিতে কি করে টেলেক্স পাঠাতে হয়, কি করে বিজনেস প্রপোসাল তৈরী করতে হয় । কম্পিউটারও পেয়ে গেলাম কিছু দিনের মধ্যে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি আগ্রহ তখন শূন্যের কোঠায়। কলেজে কিছু বন্ধু আমার হয়ে প্রক্সি দিতো আর আমি সাহেবদের মতো গিয়ে শুধু পরীক্ষা দিয়ে আসতাম। মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে সবাই পরবর্তী ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়, কোচিং করে আর সেই সময় আমি চলে গেলাম সোজা ঢাকার নবাবপুরে ইন্ডেন্টিং ব্যবসা শেখার জন্য। পারিবারিক সম্পৃক্ততা থাকায় সহজেই ব্যবসার গভীরে লুকায়িত অনেক কলা-কৌশল শিখে ফেললাম। পরিবারের বাঁধা উপেক্ষা করে স্থায়ী হয়ে গেলাম ব্যবসায় পাশাপাশি অধিকতর কম গুরুত্বে চললো লেখাপড়া।
আমাদের পাশের অফিসটাই ছিলো ওয়ালির বাবার সেই সুবাধে স্কুল জীবনে ততটা কাছের বন্ধু না হলেও নবাবপুর জীবনে এসে খুব কাছে থেকে দেখার ও চেনার সুযোগ হয় উভয়ের, খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠি দুজনে দুজনার কদিনেই। একেবারে বাড়ির অন্দরমহল পর্যন্ত যাতায়ত ছিল দুজনেরই। সদ্য সিগারেট ধরেছি, দুজনেই লুকিয়ে লুকিয়ে খাই গলাগলি করে। কোনো কোনো দিন আমরা দুজনে হেটে হেটে স্টেডিয়াম পাড়ায় চলে যেতাম সিগারেট খাওয়ার জন্য যাতে কেউ দেখে না ফেলে। স্বস্তির বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় ওয়ালি বললো চল আজকে স্টেডিয়াম যাই, আমিও রাজি হয়ে গেলাম।
স্টেডিয়ামের দক্ষিণ পশ্চিম কোনায় যে ফ্ল্যাড লাইটের টাওয়ার তার নিচে একটা ঝালমুড়ি বিক্রেতা বসতো । সেই মামার ঝালমুড়ি না খেলে ওয়ালীর আবার দিন মাটি হয়ে যেতো। সুন্দর একটা কাগজের কোন বানিয়ে তার মধ্যে দিয়ে দিত মুড়ির ভর্তা, আমি আর ওয়ালী হেটে হেটে খেতাম আর স্টেডিয়ামের দামি ইলেক্ট্রনিক্স দেখতাম, দাম জিজ্ঞাসা করতাম।
ঝালমুড়ি কেনার সময় প্রায়ই লক্ষ্য করতাম নবাবপুরের একজন প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী মুড়ি বিক্রেতার আশেপাশে একাকী দাঁড়িয়ে আনমনে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে সিগারেট খায় । আমি উনাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি, খুব বেরসিক গম্ভীর মেজাজের মানুষ। উনাকে হাসতে দেখেছে এমন মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে বিরল। সালাম দিলে শুধু মাথাটা নেড়ে সালামের উত্তর দিতেন এতটুকুই ছিল উনার সাথে আমার ভাবের লেনদেন। উনার গম্ভীর স্বভাব আমাকে যথেষ্ট অস্বস্তি দিত তাই উনাকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতাম।
আমাদের দুজনের ঝালমুড়ি কেনা শেষ হতেই দ্রুত হেটে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম এমন সময় উনি কথা বলে উঠলেন “তোমরা দুজন কি বন্ধু?”
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম
আমার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বললো তুমি মান্নান সাহেবের ছেলে না ?
ওয়ালী মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো
আচ্ছা তোমরা নবাবপুর থেকে এত দূরে কেন আসো? আমি প্রায়ই তোমাদের খেয়াল করছি বিকেলের দিকে আসো, ঝাল মুড়ি খাও, হাটাহাটি করো
আসলে আমাদের উত্তর দেয়ার কিছু ছিল না, উপরন্ত বিব্রতবোধ হচ্ছিলো এই ভেবে নিশ্চই আমাদের সিগারেট খেতেও দেখেছেন তবে।
কিছুটা সময় কেউ কিছু বললাম না, আমরা দু’বন্ধু অজানা অপরাধবোধ নিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে আছি। উনি নিজেই পরিবেশ হালকা করে বললেন বন্ধুদের একসাথে দেখলে আমার অনেক ভালো লাগে। বন্ধু ছাড়া জীবন, জানালা ছাড়া ঘরের মতো।
নিজে থেকেই আগ বাড়িয়ে বলা শুরু করলেন এই যে আমি প্রতিদিন এখানে আসি আসরের নামাজের পর আমার বন্ধুদের সাথে দেখা করার জন্য। আসলে ওদের সাথে দেখা হবে এই আশায় গত ২০ বছর ধরে প্রায় প্রতি বিকালে এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকি । বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা, আশায় পথ চেয়ে থাকা।
আমাদের দুজনের আগ্রহ দেখে বলা শুরু করলেন তার মূল গল্প……
আমরা চার বন্ধু নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীতে পড়ি, আমি তোমাদেরকে ১৯৭১ সালের কথা বলছি । আমরা তখন থাকি নবাবপুরের পেছনের মহল্লা বনগ্রামে। নবাবপুর পোষ্ট অফিসের পেছনে মহাজনপুর লেনে থাকতো বন্ধু মুকুল আর বাকি দুইজন থাকতো ওয়ারির মুচি পট্টির ওখানটায় । আমরা ক্লাস ফাইভ থেকে পাশাপাশি বেঞ্চে লতার মত জড়াজড়ি করে বেড়ে উঠেছিলাম। নবাবপুর স্কুলে খেলার মাঠ না থাকায় স্কুল ছুটি হলেই আমরা এক ছুটে চলে আসতাম এই দিকটায়। সাপ্তাহিক ছুটির দিন বা অন্য কোনো ছুটির দিনে আমাদের সকাল – বিকাল কাটতো এই খোলা মাঠে। ফুটবল খেলে, ঘুড়ি উড়িয়ে, দাড়িয়াবান্ধা আরও কত কি খেলা ছিল আমাদের। সন্ধ্যা লাগার আগেই পাশের পুকুরে সাঁতরে গোসল করে গায়ে লেগে থাকা ধূলি কাঁদা ধুয়ে ফিরে যেতাম বাড়ি ।
যুদ্ধ শুরুর হবার আগেই উত্তপ্ত হয়ে উঠলো ঢাকা। আমরা অনিয়মিত হয়ে গেলাম স্কুলে, কমতে থাকলো আমাদের দেখা সাক্ষাৎ । এতদিনের অভ্যেস বিকাল হলেই ছুটে আসা এই স্টেডিয়াম পাড়ায়, ছেদ পড়লো সেখানেও । যাদেরকে একদণ্ড না দেখে থাকতে পারতাম না তাদেরকে ২/৩ না দেখে থাকতে হচ্ছে । শেষ যেদিন স্কুল থেকে দল বেঁধে এসেছিলাম এখানটায় তা ৭১’এর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি কোনো একটা সময় হবে । আমরা বুঝতে শিখে গিয়েছিলাম একটা দীর্ঘস্থায়ী অনিশ্চয়তার মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছি আমরা । কতদিন লাগবে আবার সব আগের মতো হতে জানা ছিল না আমাদের। কথা ছিল যেদিন আবার সব ঠিক হয়ে যাবে, যেদিন থেমে যাবে যুদ্ধ – আমরা ছুটে আসবো ঠিক এইখানটায়, যেখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি। সময় ঠিক করা ছিল বিকাল পাঁচটায়।
যুদ্ধ থেমে গেলো, স্বাধীন হলো দেশ প্রথম সুযোগেই আমি ছুটে আসলাম এখানটায় কোনো একদিন বিকাল পাঁচটায়, কেউ আসলো না সেই দিন । তার পর দিন এলাম এভাবে অনেকদিন এলাম, মনে নেই কত দিন কিন্তু ওরা কেউ এলো না । স্কুল খুলে গেলো, ওরা কেউ স্কুলেও এলো না । আমার ভীষণ মন খারাপ হলো, অনেক কষ্ট পেতে লাগলো আমার মন । আমিত ওদের কারো বাড়িও চিনি না যে গিয়ে খোঁজ নেব । স্কুলের অন্যদের জিজ্ঞাসা করলাম, কেউ কিছু বলতে পারলো না, স্কুলের দপ্তরেও কোনো ঠিকানা পাওয়ার গেলো না । অনেক কষ্টে মুকুলদের বাড়ির ঠিকানাটা জোগাড় করতে পারলাম ওর পাশের বাড়ির মহল্লার ছোট ভাই ক্লাস এইটে পড়তো । ওর কাছ থেকে জানলাম মুকুল যুদ্ধে গিয়েছিলো তবে এখনো ফিরে আসেনি । গেলাম ওদের বাসায় একদিন স্কুলে আসার পথে । ওর মা জানলো যুদ্ধ লাগার এক মাস পরেই ও বাড়ি থেকে পালিয়ে যুদ্ধে চলে যায় মুকুল । একটা চিরকুটে লিখে যায় স্বাধীন দেশেই ফিরে আসবে, পরাধীন হয়ে নয় । দেশ স্বাধীন হলো, সবাই ফিরে এলো কত আনন্দ চারিদিকে, আমার মুকুল ফিরে এলো না বলে কান্নায় ভেঙে পড়লো তার মা । সে কান্না পেছনে ফেলে আমি স্কুলের পথে হাটা দিলাম । ওয়ারির মুচি পট্টির দুই বন্ধু ছিল হিন্ধু সম্পদায়ের ওদের কি হয়েছে আমি আজও জানতে পারিনি ।
আমি সেই ৭২ সাল থেকে প্রতিদিনই এখানে এসে আমার বন্ধুদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকি বিকাল পাঁচ টা বাজার আগেই । বায়তুল মোকারম মসজিদে আসরের নামাজ পড়ি তারপর একটা সিগারেট খাই এখানে দাঁড়িয়ে, এদিক ওদিক চোখ ফিরাই যদি ওরা কেউ আসে আমার খোঁজে বা আমাদের খোঁজে। কাউকে না পেয়ে যদি বন্ধুরা হতাশ হয়ে ফিরে যায়, আমি দাঁড়িয়ে থাকি এই প্রত্যাশায় একদিন দেখা হবে মুকুলের সাথে দেখা হবে বাকি দুজনের সাথেও ।
বন্ধুদের দেয়া আমার শেষ ওয়াদা আমি আজও নীরবে পালন করে যাচ্ছি, তারপর হাতের সিগারেটে টান দিয়ে উদাস চোখে তাকিয়ে রইলা সামনের খোলা মাঠের দিকে ।
আমি ও ওয়ালী মন্ত্রাচ্ছন্ন হয়ে শুনলাম উনার সব কথা, ওয়ালীর চোঝে অশ্রু, আমারও দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো । দুজনে হাত ধরাধরি করে চলে আসলাম নবাবপুর । একটা কথাও হলো না এতটা পথ। এমন কাঠখোট্টা একটা মানুষের ভেতর এমন সুন্দর একটা মানুষ কি করে লুকিয়ে থাকে ? কেমনে একজন মানুষ এমন বন্ধু হয় । বন্ধুকে দেয়া শেষ কথাটা আজও পালন করে যাচ্ছে নীরবে নিভৃতে। শ্রদ্ধায় মাথানত হয়ে এলো, অজান্তেই ভালোবেসে ফেললাম সেই বেরসিক মানুষটাকে । বন্ধুর সংজ্ঞা আমার জানা নাই, তবে আমার কাছে উনিই বন্ধুর সংজ্ঞা, আজীবনের ।