বাঙালি প্রবাসীদের সব জায়গায় অবজ্ঞা নতুন কিছু নয়। কিন্তু কেনই বা এমনটা হয়? প্রবাসীরা বাংলাদেশের জন্য কিনা করে। দেশের মোট জাতীয় আয়ের প্রায় ১৫ শতাংশই প্রবাসীদের অবদান। প্রতি বছরে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ দেশে পাঠায়, যা বাংলাদেশে বিদেশি সাহায্যের প্রায় দশ গুণ। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এদের সক্রিয় অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স কমে গেলে বাংলাদেশে হাহাকার লেগে যায়। অর্থনীতিতে চরম নেতিবাচক অবস্থা সৃষ্টি হয়।
২০০৮ সালে যখন আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দাভাব, তখন সারা বিশ্বে হাহাকার লেগে যায়। ইউরোপ, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যে—প্রায় সব দেশের অর্থনীতিতে ২০০৮ সালের আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দাভাবের প্রভাব পড়েছিল। তবে বাংলাদেশে এর আঁচড় লাগেনি। কেন লাগেনি তার উত্তর খুঁজতে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ছাত্রী নাটাচা স্টেভেনোভিক গবেষণা শুরু করেন ২০১২ সালে। তার কাছে এই প্রশ্নটি ধাঁধার মতো লেগেছিল। তার গবেষণায়, ‘রেমিটেন্সেস অ্যান্ড দি মোরাল ইকোনমিকস অব বাংলাদেশি নিউইয়র্ক ইমিগ্রান্টস ইন লাইট অব দি ইকোনমিক ক্রাইসিস’ উল্লেখ করেন, ২০০৮ সালে যখন সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দাভাব তখন কীভাবে প্রবাসীরা বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন।
নাটাচা আরও বলেছেন, বাংলাদেশি প্রবাসীদের দেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় চেতনাবোধ সত্যিই অবিশ্বাস্য। ব্যুরো অব ম্যান পাওয়ার এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেইনিংয়ের পরিচালক ড. মো. নুরুল ইসলাম এক প্রতিবেদনে বলেন, প্রবাসীরা জাতীয় অর্থনীতিতে মূলত দুইভাবে সহায়তা করে থাকেন। এক. বিদেশে গিয়ে দেশের বেকারত্বের হার কমানো এবং দুই. রেমিট্যান্স পাঠানো যা বাংলাদেশের জিডিপির ওপর দারুণ প্রভাব ফেলে।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ও ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) মতে, বাংলাদেশে ২০১৫ সালে প্রবাসীদের মাধ্যমে ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স যায় যা বাংলাদেশের জিডিপির ৮ শতাংশ। ১৯৬০ সালে যখন যুক্তরাজ্য বাংলাদেশিদের জন্য তাদের দুয়ার খুলে দেয়, তখন থেকে বাংলাদেশি প্রবাসীরা আর থেমে থাকেননি। সারা বিশ্বে তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন আর প্রতিনিয়ত দেশের জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। অন্য একটি প্রতিবেদনে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) জানায়, বাংলাদেশি মহিলা প্রবাসী কর্মীরাও পিছিয়ে নেই। ২০১৪ সালে প্রবাসী মহিলা শ্রমিকের সংখ্যা ৭৬ হাজারের বেশি।
এখন প্রবাসজীবন সম্পর্কে কিছু বলি। প্রবাসজীবন মানেই নিঃসঙ্গতা। দেশের সব মায়া ভুলে কঠোর পরিশ্রমের দিনাতিপাত করা। ১২-১৬ ঘণ্টা দৈনিক কাজ করা। প্রিয়জনকে কাছে না পাওয়া। বাংলার সুবাস থেকে বঞ্চিত হওয়া। অর্ধাহারে বা অনাহারে থাকা। মা বাবার শেষ মুখটা না দেখা। সন্তানের জন্ম না দেখা। কতই না প্রবাসীদের ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। তারপরও এরা হাসিমুখে দেশের ও দেশের মানুষের কথা ভেবে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে দ্বিধা করে না।
কিন্তু বিনিময়ে এরা কি পায়? কেন এরা সর্বত্র অবহেলার স্বীকার হয়? বিদেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক থেকে শুরু করে, বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসসহ বাংলাদেশে বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রবাসীরা শুধুই অবজ্ঞারই মুখে পড়ে। প্রবাসে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক কর্মকর্তাদের শাসানি খেতে হয়। বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তারা তো বাংলাদেশি প্রবাসীদের মানুষ হিসেবেই গণ্য করে না। বাংলাদেশে বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা প্রবাসীদের সঙ্গে কেমন আচরণ করে, তা সবারই জানা।
বাংলাদেশের দালালের প্রতারণার স্বীকার হয়ে বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই অনেকেই দিনের পর দিন কঠোর পরিশ্রম করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। এরা দেশের বোঝা হতে নারাজ। প্রিয়জনের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দেওয়ার জন্য হাসি মুখে প্রতিনিয়ত কষ্ট করে যাচ্ছেন। দেশের কর্তৃপক্ষ কি এদের জন্য কিছুই করতে পারে না? এরা দেশের জন্য অনেক দেয়, কিন্তু কেন এদের কিছুই মিলে না?