মধ্যপ্রাচ্যের দুই প্রভাবশালী প্রতিবেশী দেশের যুবরাজ, সেই সঙ্গে শাসকও। সদ্য সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে দুজনে মিলে পুরো অঞ্চল কাঁপিয়েছেন।
ছড়ি ঘুরিয়েছেন প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর। জোর করে চাপিয়ে দিয়েছেন যুদ্ধ-সংঘাতসহ নিজেদের নানা ইচ্ছা। গর্ব ভরে নিজেদের এই সম্পর্ককে বলতেন ‘কৌশলগত অবিচ্ছেদ্য কুটুম্বিতা’।
কিন্তু সম্প্রতি সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদের সেই প্রেমে মস্ত বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। স্বার্থের টানাপোড়েনে দুদেশের মধ্যে রেষারেষি বাড়ছে। মিডিল ইস্ট আই।
উপসাগরীয় রক্ষণশীল রাজতান্ত্রিক দেশ দুটির মধ্যকার যে কোনো ঝামেলাই সাধারণত রাজপ্রাসাদের চার দেওয়ালের মাঝেই মিটিয়ে ফেলা হতো। কিন্তু চলতি সপ্তাহে বৈশ্বিক তেল উৎপাদনের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের মধ্যকার বাগ্বিতণ্ডা অনেকটা বিস্ফোরণের মতো বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
তেল উৎপাদনের কোটা নিয়ে এই প্রকাশ্য তিক্ত মতভেদের পর ইতোমধ্যে নিজেদের মধ্যে আলোচনা স্থগিত করে দিয়েছে বিশ্বের বড় তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো। এর ফলে জ্বালানির বাজারে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে এবং তেলের দাম ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
বহু বছর ধরে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে অংশীদারিত্ব আরব দুনিয়ার ভূ-রাজনীতির রূপরেখা নির্ধারণ করে এসেছে। এই জোটের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং আবুধাবির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদের মধ্যকার ব্যক্তিগত বন্ধন।
এই দুই যুবরাজই কার্যত তাদের দেশ শাসন করেন এবং তাদের লক্ষ্যও উচ্চাকাক্সক্ষী। বেশ অনেকগুলো বছর ধরে দুদেশের মধ্যে কৌশলগত বিষয়ে গভীর সহযোগিতা ছিল।
তারা ইয়েমেনে ইরানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিদ্রোহী হুথি আন্দোলন দমন করার জন্য তাদের সঙ্গে লড়তে ২০১৫ সালে একটি আরব সামরিক জোট গঠন করেছিল। ২০১৭ সালে তারা কাতারের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।
কিন্তু দুবছর আগে ইউএই ইয়েমেন থেকে তাদের গরিষ্ঠসংখ্যক সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর এই দুই যুবরাজের মধ্যে সম্পর্কে ফাটল ধরে। আমিরাতের ওই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয় সৌদি আরব।
জানুয়ারি মাসে কাতারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য সৌদি নেতৃত্বে যে চুক্তি হয়, আমিরাত তা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিয়েছিল। যদিও কাতার কর্তৃপক্ষের প্রতি তাদের অনাস্থা চলে যায়নি।
একইভাবে গত বছর সংযুক্ত আরব আমিরাত যখন ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সৌদি আরবও তাতে সন্তুষ্ট হয়নি। এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এই ফাটল আরও গভীর হতে শুরু করে। সৌদি আরব বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে একটা আলটিমেটাম দেয় এই বলে যে তারা যদি উপসাগরীয় এলাকায় তাদের আঞ্চলিক সদর দপ্তরগুলো ২০২৪ সালের ভেতর সৌদি আরবে স্থানান্তর না করে, তা হলে সরকারি কোনো চুক্তি তাদের সঙ্গে করা হবে না।
ওই এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র দুবাই এই হুমকি ভালো চোখে দেখেনি। তারা এটাকে ইউএই-র ওপর পরোক্ষ একটা হামলা বলেই বিবেচনা করেছে। ওপেক প্লাসের প্রস্তাবে আমিরাত বাধা দেওয়ার পর সৌদি আরব কার্যত এর প্রতিশোধ নিতে ইউএইতে বিমান চলাচল সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। যদিও সৌদিরা বলছে এর পেছনে কারণ করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে উদ্বেগ।
কিন্তু আসন্ন ঈদুল আজহার ছুটিতে বহু মানুষ যখন দুবাইয়ের দিকে ছোটে তখন এই বিমান চলাচল স্থগিত করার সিদ্ধান্তের পেছনে কারণ শুধু করোনাভাইরাস কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সৌদি আরব আরও ঘোষণা করেছে যে তারা মুক্ত বাণিজ্য এলাকা থেকে বা অন্য যেসব উপসাগরীয় দেশের সঙ্গে ইসরাইলের বাণিজ্যিক শুল্ক সুবিধার চুক্তি আছে সেসব দেশে থেকে পণ্য আমদানি করবে না। এটাও আমিরাতের জন্য বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে একটা বড় ধাক্কা, কারণ ইউএই-র বাণিজ্য ব্যবস্থা মুক্ত বাণিজ্য কাঠামোর আওতাধীন।