ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার, এনডিসি (অবসরপ্রাপ্ত)
২৪ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) ২০২২। শীতের মধ্যরাত। ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্তের কয়েকশত মাইল দীর্ঘ সীমানায় পাইন অরণ্য, শস্যক্ষেত্র, মাঠে প্রান্তরের কোথাও রাস্তায় সামরিক মহড়ার নামে দেড় লক্ষাধিক রুশ সৈন্য প্রায় ৪৫ দিন ধরে মোতায়েন রয়েছে। তবে তারা ইউক্রেনে চুড়ান্ত আক্রমনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
ইউক্রেন অভিযানের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিনায়ক আর্মি জেনারেল আলেকজান্দার দভরনিকভকে (রাশিয়ার দক্ষিন সামরিক ডিসট্রিক্ট এর অধিনায়ক) মস্কোর সামরিক সদরদপ্তর থেকে আক্রমনের সময়টি পুনরায় নিশ্চিত করা হলো। ইউক্রেনের সময় অনুযায়ী আক্রমনের এইচ আওয়ার বা রনঘন্টা ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোর ৫টা। বলা হলো, তার আগে টেলিভিশনে চোখ রাখতে। মধ্যরাতের পর থেকেই সামরিক কমান্ডারগন আক্রমনের চুড়ান্ত প্রস্তুতি, ব্রিফিং তদারকি করছেন। ভোর ৪টা ৪৫ মিনিট। কমান্ডারগন বার বার হাতের ঘড়ি দেখছেন। মিসাইলের ক্রুগন তাদের ফায়ার সিষ্টেম কম্পিউটারে টার্গেটগুলোর ফাইনাল ডাটা দেখে নিলেন। এখন শুধু ফায়ার অর্ডারের অপেক্ষা।
শীতের ভোরে মিসাইলের বৃষ্টিপাত
ভোর ৪টা ৫৫। এক সময়ের কেজিবির দুর্ধষ গোয়েন্দা লেফটেন্যান্ট কর্ণেল ও বর্তমানে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন টেলিভিশনে ভাষন শুরু করলেন। সিনিয়র কমান্ডারগন মোবাইল ফোনে সর্বাধিনায়ক পুতিনের ভাষন দেখছেন। অর্থাৎ আর মাত্র ৫ মিনিট পরই রনঘন্টা। প্রেসিডেন্ট পুতিন তার ভাষনে ডনবাস অঞ্চলে বিশেষ সামরিক অভিযানের নির্দেশ দিলেন।
ঠিক ভোর ৫টায় সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানকারী রুশ মিসাইল ক্রুগন মিসাইলের ফায়ার বাটনে চাপ দিলেন (ফায়ার সুইচ)। শর্ট এন্ড মিডিয়াম রেঞ্জ ব্যালেষ্টিক মিসাইল, ক্রুজ মিসাইল, সারফেস টু এয়ার মিসাইল থেকে শত শত মিসাইল ছুটলো ইউক্রেনের শহরগুলোর দিকে। ইউক্রেনের মিলিটারি হেডকোয়াটার্স, এয়ার ডিফেন্স ইউনিট, কমান্ড এন্ড কন্ট্রল সেন্টার আর লজিসটিক বেইজগুলোর উপর দূরপাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র বর্ষনের মাধ্যমে আক্রমনের উদ্বোধন হলো। শহরগুলোতে বেঁজে উঠলো এয়ার রেইড সাইরেন। এর মধ্যদিয়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইউরোপের কোন দেশ আরেক দেশে সর্বাত্বক হামলা চালালো। “ট্রিগার হ্যাপি” মিসাইল ক্রুগন জানলো না, তারা কি সর্বনাশা এক যুদ্ধের সাক্ষী হয়ে রইলো।
বিশ্ববাসীকে হতবাক করলো বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরার ব্রেকিং নিউজ- “রাশিয়া এই মাত্র ইউক্রেনে আক্রমন শুরু করেছে”। মস্কোতে ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ৬ টা। এই সময় নিউইয়র্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের শেষ মুহুর্তের বৈঠকে কূটনীতিকরা শান্তির জন্য আবেদন জানাচ্ছিলেন। বসন্তের ঢাকায় তখন সকাল ৯টা।
এদিকে পুতিনের যুদ্ধ ঘোষনার কিছুক্ষন পরই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দেন। তিনি রুশ হামলা থেকে মাতৃভূমি রক্ষায় অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার জন্য ইউক্রেনের সাধারন জনগনের প্রতি আহবান জানান।
জল, স্থল ও আকাশ পথে আক্রমন
এ ধরনের হামলার মূল উদ্দেশ্য- প্রতিপক্ষের কমান্ড কন্ট্রল, এয়ার ডিফেন্স ক্যাপাসিটি, আর ইন্ডারডিকশান ক্যাপাবিলিটি ধ্বংশ করে দেয়া, যেন রাশিয়ার স্থল বাহিনীর যাতায়াত নিরাপদ ও সুগম হয়। পাশাপাশি রাশিয়ানদের সামরিক সামর্থ্যরে ব্যাপারটা আরেকবার ইউক্রেনীয়দের মনে করিয়ে দেয়া। আমেরিকা ইরাকে (২০০৩) হামলার আগে ঠিক যেমনটা করেছিল।
মিসাইল হামলার পর পরই রুশ বাহিনী বিমান হামলা ও দূরপাল্লার কামানের গোলাবর্ষন শুরু করে। সকাল সাড়ে ছয়টায় তিনটি অক্ষ রেখায় (এক্সিস অব এডভান্স) ট্যাংক, আর্মাড ফাইটিং ভেইকেল, আর্মাড পারসোনাল ক্যারিয়ার, আর্টিলারী গান সমভিব্যাহারে রাশিয়ার অগ্রগামী সৈন্যদল ইউক্রেনে প্রবেশ করে। তবে সীমান্ত অতিক্রম করার পরপরই রুশ বাহিনী ইউক্রেনের বর্ডার গার্ড সার্ভিসের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। কিছুক্ষন প্রতিরোধ করার পর বর্ডার গার্ড এর সৈন্যগন পেছনে এসে সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে যোগদান করে।
রাশিয়ার সেনাবাহিনী আক্রমন চালিয়েছে উত্তর, দক্ষিন ও পূর্ব দিক থেকে। রুশ সেনারা ঢুকছে উত্তর ইউক্রেনের চেরনিহিভ এবং পূর্ব ইউক্রেনের খারকিভ ও লুহানস্ক অঞ্চল দিয়ে। আক্রমন চালানো হয়েছে কৃষ্ণসাগরের উপকুলবর্তী দক্ষিনের বন্দরনগরী ওডেসা এবং আজভ সাগর উপক‚লবর্তী দক্ষিন-পূর্বাঞ্চলীয় মৌরিপোল শহরে। প্রথমদিনে রাশান হেভি আর্মার আর আর্টিলারি ইউনিটগুলো ক্রিমিয়া হয়ে দক্ষিণ দিক থেকে এবং বেলারুশ হয়ে উত্তর দিক থেকে এডভান্স করে দক্ষিণে কেরসন, উত্তরে-পূর্বে সুমি এবং চেরনোবিল দখল করে নেয়। কিয়েভের হোস্টোমেল বিমানবন্দরের অন্তত দুবার বেদখল আর পুর্নদখল হয়েছে। ডনবাসেও যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে।
মিশন-ইউক্রেন
প্রেসিডেন্ট পুতিন তার ভাষনে বলেন- আমাদের উদ্দেশ্য ইউক্রেনকে নিরস্ত্রীকরন ও নাৎসীমুক্তকরন করা, ইউক্রেন দখল নয়। রাশিয়ার ইউক্রেনের মূল লক্ষ্য হলো- ইউক্রেনিয় সামরিক বাহিনীকে গুড়িয়ে দেয়া, সরকারকে উৎখাত করা ও ইউক্রেনের একটা অংশ দখল করা, অর্থাৎ ইউক্রেনে সর্বাত্বক আধিপত্য বজায় রাখা। জানা যায়, পুতিনের প্রাথমিক নির্দেশ ছিল ২ মার্চ (বুধবার) এর মধ্যে বিজয়ের মাধ্যমে অভিযান শেষ করা। মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনী অনুমান করেছিল ৯৬ ঘন্টায় কিয়েভের পতন হবে। উল্লেখ্য ইসরাইল তার নিরাপত্তার অজুহাতে লেবাননে এই ধরনের আক্রমন চালিয়েছিল। রুশ বাহিনী এই অভিযানকে যত সহজ ভেবেছিল তা হয়নি। একটি পুরনো মতবাদ আছে, যে কোনও পরিকল্পনা শত্রুর সঙ্গে প্রথম মোকাবিলায় টিকে থাকে না। ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর জন্যও কথাটি সত্য বলে মনে হচ্ছে। প্রাথমিক আক্রমন অপ্রতিরোধ্য মনে হলেও এখন তা বেশ ধীর গতিতেই হচ্ছে।
রাশিয়ার দক্ষিন সামরিক ডিসট্রিক্ট এর পরিচালনায় ইউক্রেনের সামরিক অভিযান চালানো হচ্ছে। সীমান্তে ১ লাখ ৯০ হাজার এর মতো সৈন্য মোতায়েন হলেও এখন পর্যন্ত ইউক্রেন অভিযানে হয়তো এর অর্ধেক সেনা নিয়োজিত রয়েছে। অন্যদিকে জেনারেল ভ্যালেরি জালুঝনি এর নেতৃত্বাধীন ইউক্রেন বাহিনীতে বর্তমানে সৈন্য সংখ্যা হলো ২লক্ষ। রিজার্ভ সৈন্য সংখ্যাও প্রায় আড়াই লাখ। এককালে বিশ্বের তৃতীয় পরমানু শক্তিধর দেশ ছিল ইউক্রেন।
সেনা ও জনতার প্রবল প্রতিরোধ
সকল আন্তর্জাতিক আইন উপেক্ষা করে নিরাপত্তার অজুহাতে ইউক্রেনের মতো একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে রাশিয়ার আগ্রাসন মেনে নেয়নি ইউক্রেনের জনগন। মেনে নেয় নি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। ইউক্রেনের রুশ সেনারা প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। কয়েকটি শহরে পথে পথে দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হচ্ছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রুশ বাহিনী খারকভে ঢুকলেই তাদের প্রতিহত করেছে ইউক্রেনিয় সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। রাজধানীকেও রুশ সেনামুক্ত করার ঘোষনা দিয়েছে তারা। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো সৈনিক, পুলিশ, সীমান্তরক্ষী ও আম জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ। এখানেই সম্ভবত পুতিনের হিসাবের ভুল হয়েছে।
ইউক্রেনের সেনারা অস্ত্র হাতে লড়ছেন। খালি হাতেও রুশ বাহিনীর ট্যাংকের সামনে দাঁড়াচ্ছে সাধারন মানুষ। শক্তিশালী রুশ বাহিনীর আক্রমনের মুখে বেশ ভালো প্রতিরোধ গড়েছে ইউক্রেন সেনাবাহিনী। যুদ্ধের শুরুতেই রুশ বাহিনীর মিসাইল ও বিমান আক্রমনে ইউক্রেনীয় বিমান বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও সেনাবাহিনীর যুদ্ধের সামর্থ এখনও অক্ষুন্ন রয়েছে। তবে সেনাবাহিনীর স্থায়ী স্থাপনাগুলো বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ইউক্রেনের ন্যাশনাল গার্ড, পুলিশ বাহিনী, বর্ডার গার্ড, টেরিটোরিয়াল আর্মি কার্যকর রয়েছে। ফলে শহরগুলো দখল হলেও ইউক্রেনিয় বাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডারগন বেশ কিছুদিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম হবেন। বিশ্ববাসীর সমর্থন পেয়ে ইউক্রেনিয় স্বদেশবাসীদের মনোবল বেশ উঁচুতে। অন্যদিকে রুশ বাহিনীর মনোবল ক্রমশ নিম্নগামী।
রাশিয়ার সেনাদের বিরুদ্ধে বেসামরিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ইউক্রেনের সাধারণ জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী। প্রতিরোধ গড়তে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নির্দেশিকায় বলা হয়- “আপনাদের কাছে অস্ত্র বা গোলাবারুদ থাকুক বা না থাকুক, সাধ্যমতো সব উপায় ব্যবহার করে লড়াই চালিয়ে যান”। ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে মালোটভ ককটেল। এর পাশাপাশি শত্রু সেনার মনোবল নষ্ট করতে নানা পদক্ষেপও চলছে। ইউক্রেনের সাবেক একজন প্রেসিডেন্ট নিজেই অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নেমেছেন। সামরিক অভিযান ঠেকানোর পাশাপাশি ইউক্রেনে রাশিয়ার ডিজিটাল অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আইটি সেনাবাহিনী চালু করেছে ইউক্রেন। ইতিমধ্যে দেশটির হ্যাকারদের রাশিয়ার সেনাদের বিরুদ্ধে সাইবার গুপ্তচরবৃত্তি পরিচালনারও আহবান জানিয়েছে দেশটি। প্রশ্ন হলো, কতদিন এই প্রতিরোধ চলবে?
একটি অসম্পূর্ণ আভিযানিক পর্যালোচনা
ইউক্রেনে রনাঙ্গনের পূর্ণাঙ্গ চিত্রটি এখনও পরিষ্কার নয়। গত ৭ দিনে দুই বাহিনীর আভিযানিক পারফরমেন্স নিয়ে বিশ্লেষন/পর্যালোচনা সময় এখনো আসেনি। তবুও আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, রাশিয়ান বাহিনী অভিযানটা যত সহজ ভেবেছিল তা মোটেই তা নয়। প্রকৃতপক্ষে রুশ বাহিনীর এই ধরনের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেই। আফগানিস্তান, চেচনিয়া, জর্জিয়ার পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া প্রায় বিনা প্রতিরোধে দখল করা সম্ভব হয়েছিল। রুশ বাহিনী এমন প্রতিরোধ সম্ভবত আশা করেনি। তারা ভেবেছিল অন্তত পূর্বাঞ্চলে রুশ ভাষাভাষী ইউক্রেনিয়রা রুশ বাহিনীকে স্বাগত জানাবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী রাশিয়ার আক্রমন এগুচ্ছে না।
প্রথম ৩ দিনে যুদ্ধে ‘চমকপ্রদ’ অগ্রগতি দেখাতে পারলেও গত রবিবার থেকে ইউক্রেনের মুখোমুখি লড়াইয়ে তেমন সাফল্য পায়নি রুশ বাহিনী। কিয়েভ উপকন্ঠে ৪৮ ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছে তারা। কারণ শহরে ঢুকতে গেলে কড়া প্রতিরোধের সম্ভাবনা। শুক্রবার ইউক্রেনের একটি বড় শহরের নিয়ন্ত্রন নিয়েও রবিবার ইউক্রেন সেনা ও জনগনের প্রতিরোধে তা হাতছাড়া হয়েছে। তবে রুশ বাহিনী পূর্বাঞ্চলে অধিকতর আভিযানিক দক্ষতা দেখিয়েছে।
জানা গেছে, রুশ বাহিনীর ব্রিগেড ট্যাকটিকাল গ্রুপ ও ব্যাটেলিয়ান ট্যাকটিক্যাল গ্রুপগুলো সন্তোষজনকভাবে অপারেশন করতে পারছে না। আশ্চর্যজনকভাবে এগুলি এই ধরনের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতও নয়, সুগঠিতও নয়। নতুন অপেশাদার সৈনিকরা (কনসক্রিপট) তেমন দক্ষ নয়। ইউক্রেনিয় সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান বা ব্লকিং পজিশনগুলোতে এসে রুশ ইউনিটগুলো ভাগ হয়ে যাওয়ার ফলে অভিযানিক কার্যকরতা কমে যাচ্ছে। রুশদের কিছু লজিসটিকস সমস্যা (খাবার, গাড়ির তেল ইত্যাদি) দেখা দিয়েছে। বাহিনীগুলোর মধ্যেও সমন্বয়ের অভাব আছে বলে জানা গিয়েছে। গোয়েন্দা তথ্যের ঘাটতিতো রয়েছেই। তবে রুশ বাহিনী বেশ সতর্কতার মধ্যে অভিযান পরিচালন করছে। যুদ্ধে সর্বাত্বক শক্তি এখনও নিয়োগ করেনি। কিছু ঘটনা ছাড়া নির্বিচার গুলি চালানো বা বোমা হামলা এখনও শুরু করেনি। তবে রাশিয়ান অধিনায়কগন হয়তো পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে (অপ্রত্যাশিত প্রতিরোধ) দ্রুত তাদের পরিকল্পনা বদলে নেবে।
সর্বশেষ পরিস্থিতি
রাশিয়া হামলা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি নতুন হুমকি দিচ্ছে। পুতিন সেনাবাহিনীকে পরমানু অস্ত্রের বহর প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। বেলারুশের গোমেল অঞ্চলে একটি শহরে মস্কো ও কিয়েভের প্রতিনিধি দলের বৈঠক হয়। সেদিন রনক্ষেত্রে গর্জন কিছুটা কম থাকলেও বৈঠক শেষ হতে না হতেই খবর আসে কিয়েভ ও খারকভে যুদ্ধের গতি বেড়েছে। অভিযানের ৫ম দিনে ইউক্রেনের আকাশ নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নেওয়ার দাবি করছে রাশিয়া। ইউক্রেনের দক্ষিণে বন্দরনগরী বার্দিয়ানস্কে সোমবার রাশিয়ার ১৫টি ট্যাংক ঢুকেছে। বার্দিয়ানস্ক থেকে ৮৫ কিলোমিটার দূরে মারিওপোলের নিয়ন্ত্রণ এখন রাশিয়ার। বেশ কয়েকটি শহরের নিয়ন্ত্রণ এখন রাশিয়ার।
ইউক্রেনের সঙ্গে সমঝোতা আলোচনার পর হামলা জোরদার করেছে রাশিয়া। গত মঙ্গলবার ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ, দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভ এবং দক্ষিণাঞ্জলীয় বন্দরগরী মারিওপোলিতে ক্ষেপণাস্ত্র ও গোলা নিক্ষেপ করেছেন রুশ সেনারা। উত্তর-পূর্বাঞ্চলী শহর ওখতিরকায় সামরিক ঘাঁটিতে গোলা হামলায়৭০ জনের মতো ইউক্রেনীয় সেনা নিহত হয়েছেন।
কিয়েভ দখলের পথে রুশ বাহিনী
রাশিয়ার প্রায় ৪০ মাইল লম্বা একটি সাঁজোয়া বহরের ছবি ধরা পড়েছে উপগ্রহচিত্রে। বহরটি ধীরে ধীরে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের দিকে এগুচ্ছে। ওই বহরে সেনাসদস্যার সঙ্গে ট্যাংক, সাঁজোয়া গাড়ি আছে। এ ছবি প্রকাশ্যে আসার পরেই কিয়েভ সংলগ্ন এলাকা বোমা ফেলতে শুরু করেছে রাশিয়া।
ইউক্রেনের “সেন্টার অব গ্রাভিটি” কিয়েভ শহরের পতন ঘটাতে যাচ্ছে রাশিয়া। বিভিন্ন সামরিক স্থাপনার কাছে থেকে নগরবাসীদের দ্রুত সরে যেতে বলেছে রুশ কর্তৃপক্ষ। রুশ বাহিনী বিভিন্ন সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, চারদিনের মধ্যে কিয়েভের পতন হতে পারে। রাশিয়ার যুদ্ধের সপ্তম দিন বুধবার। কিয়েভের অভিমুখে থাকা রুশ সেনাবাহিনীর দীর্ঘ গাড়িবহরটি অনেকখানি কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বহরটি এখন কিয়েভ থেকে মাত্র প্রায় ১৫ মাইল উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থান করছে।
যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি
যুদ্ধ থেকে বাঁচতে ইউক্রেন ছেড়ে পালাচ্ছে মানুষ। এ পর্যন্ত শরনার্থীর সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। রাশিয়া সামরিক অভিযান শুরুর পর ৫ দিনে ৫ হাজার ৭১০ জন রুশ সেনা নিহত হয়েছেন। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা এ দাবি করেছেন । অন্যাদিকে রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনে ১৪ শিশু সহ ৩৫২ জন বেসামরিক নিহত হয়েছে বলে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় জানিয়েছে। রুশ কর্তৃপক্ষ কিছু ক্ষয়ক্ষতির কথা স্বীকার করলেও সংখ্যা জানায়নি।
একদা ন্যাটো সদর দপ্তরের বহিঃপ্রাঙ্গনে
২০১৮ সালের গ্রীষ্মে এসেছিলাম বেলজিয়াম ভ্রমনে। ব্রাসেলসের দর্শনীয় স্থানগুলো যেমন রাজপ্রাসাদ, গ্রান্ড প্লেস, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সদরদপ্তর, মিউজিয়াম ও এটোমিয়াম দেখে পৌঁছলাম হারেনে। ব্রাসেলসের হারেনেই ন্যাটো সদরদপ্তর অবস্থিত। ২০১৭ সালে নির্মিত বিশাল এই কার্যালয়ের সামনে ক্রমবর্ধমান সারি সারি পতাকার শোভা। ফিজিক্যাল- নিরাপত্তার বাহুল্যমুক্ত, নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরে অপরূপ ফুল বাগানের সামনে সহ-ভ্রামনিকদের পাল্লায় পড়ে সস্ত্রীক রোমান্টিক ভঙ্গিতে ছবি টবিও তোলা হলো। সেই সময় ঘুনাক্ষরে মনেই হয়নি, কয়েক বছর পর ইউক্রেনে ন্যাটোর স¤প্রসারন (অন্যতম কারন) নিয়ে ভূমিকম্পের মতো এমন প্রলয় কান্ড ঘটবে।
ভয়াবহ এক ভবিষ্যত- চিত্র!
যদি খুব শ্রীঘ্রই আলোচনার মাধ্যমে এই সংকটের সমাধান না হলে ভবিষ্যতে ইউক্রেনের পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। মনে হচ্ছে ইউক্রেনের কিছু অংশ দখল করে ইউক্রেনের সরকারকে আত্মসমর্পন করার সুযোগ দেবে রাশিয়া। না মানলে পুরোমাত্রায় আক্রমন। এক পর্যায়ে জনতার প্রতিরোধ ভেঙে পড়লে, ক্ষমতায় বসানো হতে পারে পুতুল সরকারকে। রাশিয়ার দখলদারিত্ব এবং পুতুল সরকার ইউক্রেনের গনযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখিন হবে। যেমনটা হয়েছিল ইরাক ও আফগানিস্তানে। অর্থাৎ এন্ড গেম হয়তো ইন্সারজেন্সি, ন্যাটোর প্রক্সি ওয়ার। একটা সময়ে ইউক্রেনের মানুষ মুক্ত হলেও ততদিনে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হবে। লক্ষ লক্ষ মানুষ শরণার্থী হবে। ধ্বংসস্তুপে পরিনত হবে ইউক্রেন। আর এইযুদ্ধে ন্যাটোদেশসমুহ সরাসরি জড়িত হলে, বিশ্বের জন্য অকল্পনীয় বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে। তবে দীর্ঘস্থায়ী হলে এটি হবে নতুন ধরনের যুদ্ধ। সাইবার যুদ্ধ, তথ্য যুদ্ধ, হাইব্রিড যুদ্ধ কার্যকর হতে পারে এখানে। তবে এই যুদ্ধের বিজয়ী শুধুই একজন- আন্তর্জাতিক সমর শিল্প।
পুতিনই কি প্রথম আগ্রাসী?
একটি বিষয় খুব আলোচিত হচ্ছে। তাহলো আগ্রাসনের ক্ষেত্রে পুতিন কাকে অনুসরণ করছেন? হিটলারকে? মোটেই না। হিটলারের অনেক পরে, নিরাপত্তার অজুহাতে পশ্চিমা বিশ্বের অসংখ্য আগ্রাসন বিশেষত ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়ায় লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু এখনও মানুষের মনে দুঃখের স্মৃতি জাগানিয়া দগদগে ঘায়ের মতোই জীবন্ত। কারো কারো কাছে, ইসরাইলের নিষ্ঠুর গনহত্যার স্বীকার ফিলিস্তিনিরা শুধুই যেন ‘সন্ত্রাসী’।
সিআইএ সদরদপ্তরে শ্যাম্পেইন পার্টি?
যুদ্ধ শুরু হলে কতো ধরনের তথ্য, কথা যে উড়তে থাকে। ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ ইত্যাদি পাখা গজিয়ে নীলাকাশে ভাসে সানন্দে। ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর। ওয়াশিংটন ডিসি’র কাছে অবস্থিত সিআইএ সদরদপ্তর ল্যাংলেতে আজ প্রচুর ব্যাস্ততা। সকাল সাড়ে এগারোটায় সিআইএ’র বিশেষভাবে সজ্জিত অফিস ‘আলিবাবা কেভ’ এ প্রেসিডেন্ট কার্টার উপস্থিত হলেন। সেদিন প্রেসিডেন্টকে জানানো হলো যে- রাশিয়ার অগ্রগামী আর্মাড ডিভিশনের সৈন্যবাহিনীর আর্মাড পারসনাল ক্যারিয়ারগুলো বিনা বাধায় অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে আফগানিস্তানের কাবুলে ঢুকে পড়বে। প্রেসিডেন্টকে বিস্তারিত বিবরন দিয়ে নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রেজনস্কি বললেন- “মিঃ প্রেসিডেন্ট রাশিয়া ঐ কাজটি করেছে ঠিক যেভাবে আমরা চেয়েছি। রাশান ভাল্লুক এখন ফাঁদে পড়েছে। আফগানিস্তানই হবে রাশিয়ার ভিয়েতনাম”। এর প্রায় দশ বছর পর, ১৯৮৯ সালে আফগান যুদ্ধ শেষে সোভিয়েত বাহিনীর অপমানজনক পশ্চাদপসরনের পর প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ (সিনিয়র) শ্যাম্পেইনের বোতল খুলে বিজয় উদযাপন করেছিলেন সেই ল্যাংলেতেই। উল্লেখ্য ইউক্রেন আক্রমনের চলমান ঘটনা এবার (২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২) আরও সবিস্তারে ও সপারিষদে দেখেছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এবারও কি সিআইএ সদরদপ্তরে কোন শ্যাম্পেইন পার্টি উদযাপিত হয়েছিল?
একজন কিয়েভবাসী যুদ্ধ-প্রবীনের ভাবনা
রুশ আগ্রাসনের পরে প্রানের ভয়ে দেশ ছাড়ছে লক্ষ লক্ষ ইউক্রেনীয়। কিয়েভ শহরে এখনো বেশ কয়েকজন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের যুদ্ধ প্রবীন (ভ্যাটরান) বেঁচে আছেন। এই যুদ্ধপ্রবীনদের কেউ কেউ হিটলারী বাহিনীর (জার্মান) বিরুদ্ধে রুশ সৈনিকদের সঙ্গে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন, কেউ কেউ হাত-পা হারিয়েছেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে স্ট্যালিনগ্রাদ, লেনিনগ্রাদ, কিয়েভের যুদ্ধে সোভিয়েত সৈনিক ও জনগনের বীরত্বগাথা ও আত্মত্যাগ ইতিহাসের অবিস্মরনীয় অংশ। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ তার বিখ্যাত ভাষনে চট্টগ্রামের প্রতিরোধ যুদ্ধকে স্ট্যালিনগ্রাদের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। অশতিপর বৃদ্ধ, অসহায় এক যুদ্ধ প্রবীন কিয়েভের এক উচু অ্যাপার্টমেন্ট থেকে দেখছেন রুশ ট্যাংকের আনাগোনা। ভাবছেন, হয়তো রুশ ক্ষেপনাস্ত্রের গোলায় তিনিই নিজেই হয়তো একসময় দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরন করবেন। জার্মান বাহিনীর পরিবর্তে এখন রুশ বাহিনী কিয়েভ ঘিরে ফেলছে। এক সময়ের সংগ্রামী কিভাবে পরবর্তিতে আগ্রাসী হয়ে যায়।
আলোচনার মাধ্যমে এ ধরনের বড় সংকট নিশ্চয়ই নিরসন সম্ভব। আশাকরি শেষ পর্যন্ত শুভবোধের জয় হবে। বন্ধ হোক দুই “স্লাভিক ব্রাদারের” অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধ।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক