ড. রাশিদুল হক
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর এ অঞ্চলে শিক্ষাব্যবস্থার বিবর্তন আমরা যেভাবে দেখেছি, তা বেশির ভাগ সময় ঘটেছে শিক্ষাকে যুগোপযোগী বা জাতীয় উন্নয়নের গতিধারা বজায় রাখার কারণে। আবার কোনো কোনো সময় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল বিশেষ রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতাদর্শের আলোকে।
তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, সময়ের ব্যবধানে এবং যুগের চাহিদা বিবেচনায় দেশে শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে বটে; তবে একটি জীবনমুখী, বৃত্তিমূলক ও সংস্কৃতিমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থা এ যাবৎ বাস্তবায়ন হয়নি।
আজীবন সংগ্রাম আর ত্যাগে আমাদের মহান স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার আদর্শ ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় অনুধাবন করেছিলেন, বাঙালি জাতির প্রকৃত মুক্তি আসবে উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে।
তাই তিনি বলেছিলেন, ‘আগামী প্রজন্মের ভাগ্য শিক্ষকদের ওপর নির্ভর করছে।’ কালক্ষেপণ না করে জাতীয় অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালার সঙ্গে তিনি ১৯৭২ সালে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-ই-খুদাকে প্রধান করে স্বাধীন দেশের উপযোগী ও সমাজগঠনমূলক প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। নতুন সংবিধানের চার মূলনীতি-ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টটি তৈরি হয়েছিল।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দেশ গঠনে উচ্চশিক্ষাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন এবং সেই লক্ষ্যে দেশের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর জন্য ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আইন পাশ করেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দিক থেকেও আমরা বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা দেখতে পাই।
প্রাথমিক শিক্ষাকে আট বছর মেয়াদি করে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চার বছরের ডিগ্রি কোর্স এবং এক বছরের মাস্টার্স কোর্সের সুপারিশ করা হয়। কমিশনের আরও একটি নির্দেশনা ছিল উল্লেখযোগ্য-পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কেবল মাতৃভাষাই হবে শিক্ষার মাধ্যম, আর বিদেশি ভাষা ইংরেজি শুরু হবে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে।
কিন্তু ’৭৫-পরবর্তী সময়ে এ সুপারিশ মানা হয়নি। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিষয়েও এ রিপোর্টে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করা হয়েছিল। শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে গ্রেডিং পদ্ধতি প্রবর্তনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন, গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার সুপারিশ করায় দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি ভিন্নধারার দূরদর্শিতা পরিলক্ষিত হয়।
বঙ্গবন্ধু একটি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্বাধীন দেশের প্রথম বাজেটে তিনি শিক্ষা খাতে জাতীয় ব্যয়ের কমপক্ষে ৭ শতাংশ বরাদ্দের সুপারিশ করেন। কুদরাত-ই-খুদা কমিশনের রিপোর্ট প্রদান করা হয় ১৯৭৪ সালের ৩০ মে। তবে ১৯৭৩ সালের ৮ জুন সংসদ ভবনে এ কমিশনের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে জমা দেওয়া হয়েছিল।
পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক মনোভাবাপন্ন শরীফ শিক্ষা কমিশনের মধ্যযুগীয় শিক্ষাব্যবস্থার তুলনায় ড. কুদরাত-ই-খুদা আনীত শিক্ষানীতি ছিল আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত ও অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত এ কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পাকিস্তানের প্রাচীনপন্থি প্রশাসনব্যবস্থা নবীন রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থার বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনের বিরুদ্ধেই কাজ করেছিল।
পরবর্তী সময়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে পর্যালোচনা করার তাগিদে উপর্যুপরি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে : তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বে শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি-১৯৭৮, মজিদ খানকে প্রধান করে ‘মজিদ খান শিক্ষা কমিশন’-১৯৮৩, তবে মজিদ খান শিক্ষা কমিশন অকার্যকর হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য মফিজউদ্দীন আহমদকে সভাপতি করে আবারও একটি ‘বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন’-১৯৮৭ গঠন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য শামসুল হকের নেতৃত্বে ‘শামসুল হক শিক্ষা কমিটি’-১৯৯৭, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যকে প্রধান করে ‘এমএ বারী শিক্ষা কমিশন’-২০০১, যার সুপারিশ কখনো আলোর মুখ দেখেনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যকে প্রধান করে ‘মনিরুজ্জামান মিয়া শিক্ষা কমিশন’-২০০৩ এবং সর্বশেষ জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে ২০০৯ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০, বর্তমানে যা কার্যকর রয়েছে।
১৯৭৪ সালের কুদরাত-ই-খুদা কমিশন রিপোর্ট এবং ১৯৯৭ সালের শামসুল হক শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের আলোকে অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর কমিটি একটি নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে, যার মূল লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের সচেতন করা। এ শিক্ষানীতিতে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ আট বছর এবং মাধ্যমিক স্তরের মেয়াদ চার বছর (নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি) সুপারিশ করা হয়।
এ শিক্ষানীতিতে মুখস্থবিদ্যার পরিবর্তে সৃজনশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির ওপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এছাড়া চিকিৎসা, সেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষার ক্ষেত্রকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষকের পদমর্যাদা, শিক্ষা প্রশাসন এবং শিক্ষাস্তর সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নকশা রয়েছে এ শিক্ষানীতিতে। এ শিক্ষানীতিতে জাতির আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছে বলে বিভিন্ন মহল মনে করছে।
বর্তমানে দেশের শিক্ষানীতি কোন ধারায় চলছে?
এতগুলো কমিশন রিপোর্টের পরও কিন্তু দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মূলনীতি পাশ কাটানো চলছে। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে গত চার দশকে দেশে একের পর এক শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে; কিন্তু জাতীয় শিক্ষার উন্নয়নে এর ফলাফলই বা কী এসেছে! অনেকের মতে যে-কে-সেই, অর্থাৎ শুধু কমিটি বদলেছে, কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত কোনো পরিবর্তন আসেনি। স্বার্থান্বেষী মহলের আরোপিত বিতর্কিত কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্তির কারণে কোনো শিক্ষানীতিরই শতভাগ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন কখনো সম্ভব হয়নি এবং অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষানীতিতে জাতির আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার অনেকটাই প্রতিফলন ঘটেনি।
তাছাড়া শিক্ষাব্যবস্থা তথা উচ্চশিক্ষায় সামাজিক মূল্যবোধেরও অবক্ষয় ঘটেছে। অনেক শিক্ষকের নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয় হয়েছে। অবশ্য নীতিবিবর্জিত কিছু মানুষের জন্য পুরো শিক্ষকসমাজকে দায়ী করা যাবে না। আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়-দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য এক ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। ‘পাবলিক শিক্ষার’ জায়গায় এখন ‘প্রাইভেট’ শিক্ষাই মুখ্য হয়ে উঠছে। বর্তমানে শিক্ষার মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য কোনোটাই পরিষ্কার নয়। দেশে অনেক ক্ষেত্রে নিুশিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা-সবই যেন এখন বাণিজ্যের উপকরণ। কোচিং সেন্টার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো রূপান্তরিত হয়েছে যেন পণ্যশালায়।
এ কারণে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও পাকাপোক্ত হচ্ছে এবং শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য প্রকট হয়েছে। এছাড়া সাম্প্রদায়িক মানসিকতার জন্ম হয়েছে, যা কুদরাত-ই-খুদা কমিশনের সম্পূর্ণ বিপরীত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি প্রসঙ্গে একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বৈষম্যের যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে, তা জাতীয় শিক্ষানীতির সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক বলেও আমি মনে করি (www.dainikamadershomoy.com/post/326467)। কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষাব্যবস্থার আলোকে আমাদের যে উপলব্ধি তা হলো, শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যে শুধু ব্যক্তিত্ব, জ্ঞান আর দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠবে তা নয়, তাদের বিশ্লেষণ আর কাজ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, থাকবে না কোনো আত্মমর্যাদার দাম্ভিকতা বা আর্থসামাজিক বৈষম্য।
বিজ্ঞানচর্চার পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকলে শিক্ষাব্যবস্থায় পরনির্ভরতা যেমন দূর হবে না, তেমনই গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সনদনির্ভর সংস্থা হিসাবেই টিকে থাকতে হবে। এর প্রমাণ হিসাবে আমরা তো দেখছি যে জ্ঞানসূচকে বিশ্বের মধ্যে দেশের অবস্থান আজ কোথায়। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
আদর্শ চিন্তাচেতনায় বলীয়ান হয়ে আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। ড. কুদরাত-ই-খুদা আধুনিক বিশ্বমানের একটি বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেই প্রত্যাশিত শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন করতে আমরা আজও ব্যর্থ হয়েছি। আমরা যে তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই রয়ে গেছি। দেশ ও জাতির কল্যাণে বঙ্গবন্ধুর আরও অনেক বছর বেঁচে থাকা বড়ই প্রয়োজন ছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র্যকে জয় করে বিশ্বসভায় বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করবে-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
ড. রাশিদুল হক : সাবেক উপ-উপাচার্য, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী; সাবেক অধ্যাপক, এমোরি বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অব মেডিসিন, আটলান্টা, যুক্তরাষ্ট্র