আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী রাগিব
আদালতপাড়ার যে কয়টি শব্দ জনসমাজে বহুল চর্চিত ও পরিচিত, এর মধ্যে ‘রিমান্ড’ একটি। তবে এই পরিচিতিটা পুরোপুরিই নেতিবাচক। এদেশে ‘রিমান্ড’ মানেই যেন বাদুড়ধোলাই, ডিম থেরাপি, ওয়াটার থেরাপি, বোতল থেরাপি, ডিস্কো ড্যান্স থেরাপি (ইলেকট্রিক শক), সুঁই থেরাপি, ঝালমুড়ি থেরাপি (চোখে-নাকে মরিচ), গিঁটা নির্যাতন, বাতাস নির্যাতন, উলঙ্গ নির্যাতন ইত্যাদি চিত্র-বিচিত্র ও অভিনব নির্যাতনের হাতিয়ার! শব্দটা সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে ১৯৯৮ সালে-রিমান্ডে ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র শামীম রেজা রুবেলের মৃত্যুর পর। এরপর এ তালিকায় যুক্ত হয় বহু নাম। এদেশে জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে এতটা অনাচারের ঘটনা ঘটেছে; এখানে ‘রিমান্ড’ আর ‘অমানুষিক নির্যাতন’ বা ‘হেফাজতে মৃত্যু’ যেন প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছে। তবে চিত্রনায়িকা পরীমনির ঘটনায় ‘রিমান্ডের’ কপালে এবার যুক্ত হলো ‘অযাচিত ও অতিরিক্ত রিমান্ডের’ তকমা। পরীমনিকে তিন দফায় ৭ দিন পুলিশ হেফাজতে রিমান্ডে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই রিমান্ডের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটের শুনানিতে হাইকোর্ট মন্তব্য করেন, ‘রিমান্ডের উপাদান ছাড়া তদন্ত কর্মকর্তা প্রার্থনা দিল, আপনি (ম্যাজিস্ট্রেট) মঞ্জুর করে দিলেন, এগুলো কোনো সভ্য সমাজে হতে পারে না।’ উচ্চ আদালতের এমন মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ ঘটনায় আদালত এতটাই ক্ষুব্ধ যে, পরীমনির দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার রিমান্ড মঞ্জুরের কারণ জানতে চেয়েছেন। ১০ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দুই ম্যাজিস্ট্রেটের ব্যাখ্যাসহ প্রতিবেদন চেয়েছেন। একই সঙ্গে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে নথিসহ ১৫ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দিয়েছেন। উচ্চ আদালতের এমন ক্ষোভ সংগত। রিমান্ড নিয়ে উচ্চ আদালতের এমন উষ্মা ও আদেশ জনস্বার্থে যেমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; তেমনই রিমান্ডের অপব্যবহার রোধে তা অনন্য এক দৃষ্টান্ত। চলুন উচ্চ আদালতের এমন ক্ষোভের কার্যকারণ অনুসন্ধান করা যাক।
মামলার জট খুলতে নিঃসন্দেহে তদন্তের কোনো বিকল্প নেই। অপরাধের অতল রহস্যের তল খুঁজতে অভিযুক্ত বা সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদের বিকল্প নেই। বিপরীতে ওই কাজ করতে গিয়ে নাগরিকের ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণেরও সুযোগ নেই। তাই আইনের সাধারণ বিধান হলো, ওই কাজ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। কারণ বিনা ওয়ারেন্টে কাউকে আটকে রাখার সুযোগ ওই ২৪ ঘণ্টা পর্যন্তই। তদন্ত বা জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজনে কাউকে এর চেয়ে বেশি সময় আটকে রাখতে চাইলে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের ‘বিশেষ আদেশ’ লাগবে। অতিরিক্ত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কাউকে আটক রাখার এ প্রক্রিয়ার প্রচলিত নামই হলো ‘রিমান্ড’। এ শব্দের ব্যাখ্যায় সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেছেন, ‘জবসধহফ’ মানে পুনরাটক বা পুনঃপ্রেরণ করা। রিমান্ড মানে মামলা তদন্ত বা বিচার সাপেক্ষে আসামিকে পুনরায় হাজতে আটক রাখা। আসামিকে আটক করে পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে প্রেরণ করলে তদন্ত সাপেক্ষে আদালত তাকে জেল হাজতে বা পুলিশের জিম্মায় আটক রাখার বা তাকে জামিনে মুক্তির আদেশ দিতে পারেন। মূলত ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারামতে রিমান্ডের বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত হয়।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে, রিমান্ডের এই ‘বিশেষ আদেশ’ একজন ম্যাজিস্ট্রেট কখন দেবেন? সে ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় কী কী? উচ্চ আদালতের বিভিন্ন রায়ে এ বিষয়ে বলা হয়েছে-‘রিমান্ড মঞ্জুরটা’ যান্ত্রিকভাবে চর্চার কোনো বিষয় নয়। বরং অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এবং আইনানুগভাবে চর্চার একটা বিষয়। এক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটকে অবশ্যই দেখতে হবে, অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ বা সংবাদটি সুপ্রিতিষ্ঠিত বা সুদৃঢ় (‘well founded’) কি না, রিমান্ডটা প্রকৃত অর্থে তদন্তে সহায়তা করবে কি না। তাছাড়া রিমান্ড ‘চাহিবামাত্র দিতে বাধ্য থাকিব’ টাইপের কোনো বিষয় নয়। এটা কোনো রুটিন ওয়ার্ক নয় যে, আবেদন জানালেই তা মঞ্জুর করতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেট অবশ্যই এখানে তার ‘বিচারিক মন’ (ঔঁফরপরধষ গরহফ) প্রয়োগ করবেন। তজ্জন্য তিনি পুলিশের কেস ডায়রিটা অবশ্যই খুঁটিয়ে দেখবেন। তাতে অভিযোগের পক্ষে পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ আছে কি না, তা রিমান্ড মঞ্জুরের জন্য পর্যাপ্ত বা Justified কি না এবং সব মিলিয়ে আনীত অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় কি না ইত্যাদি বিষয় বোঝার চেষ্টা করবেন। উপরিক্ত সবকিছু বিবেচনায় তিনি যদি রিমান্ড দিতে চান, তবে আদেশে তার কারণগুলো সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করতে হবে। রিমান্ডের আবেদনের সঙ্গে পুলিশ যদি কেস ডায়েরি দাখিল না করে কিংবা অভিযোগটা যদি সুদৃঢ় (‘well founded ’) না হয়, তবে রিমান্ড মঞ্জুরের সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের ফৌজদারি কার্যবিধির উৎস ও রূপরেখা প্রায় এক। কিন্তু রিমান্ডে নাগরিক অধিকার সুরক্ষায় ভারত ও পাকিস্তানের ফৌজদারি কার্যবিধি এক ধাপ এগিয়ে। পাকিস্তানের আইনে ম্যাজিস্ট্রেট কোনো মহিলাকে পুলিশ হেফাজতে আটক বা জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দিতে পারেন না। সেখানে একজন মহিলাকে জেল হাজতে ১ জন কারা কর্মকর্তা ও ১ জন মহিলা পুলিশ কর্মকর্তার সামনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয়। ভারতে ১৮ বছরের কম বয়স্ক মহিলাকে রিমান্ডে পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার সুযোগ নেই। তাকে রিমান্ড হোম বা স্বীকৃত সামাজিক প্রতিষ্ঠানের হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয়। এমন নিয়ম বা বিধি আমাদের আইনে নেই। তবে উচ্চ আদালতের রায়ে বিষয়টি ভিন্নভাবে কিছুটা এসেছে।
২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল সন্দেহভাজন কোনো আসামি বা ব্যক্তিকে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেওয়ার বিষয়ে ১৫ দফা নির্দেশনাসহ যুগান্তকারী এক রায় দেন হাইকোর্ট, যা ২০১৬ সালে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে বহাল রাখা হয়।
ওই রায়ে ‘রিমান্ড’-এ থাকাবস্থায় আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশি আচরণ সম্পর্কে নিন্মোক্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়-
(ক) কারাগারে একপাশে কাচ ও গ্রিল সংবলিত ‘বিশেষ কক্ষে’ জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী বা নিকটাত্মীয় থাকতে পারবেন। শুনতে না পেলেও তারা যেন জিজ্ঞাসাবাদ পর্বটা দেখতে পায়, সেখানে এমন ব্যবস্থা থাকবে।
(খ) উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে আসামিকে সর্বোচ্চ তিনদিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে। উল্লেখ্য, পরীমনিকে ১ম দফায় ৪ দিন, পরে দুই দফায় আরও ৩ দিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের ঘটনা ঘটে।
(গ) পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দানের আগে ম্যাজিস্ট্রেট অবশ্যই আসামিকে গ্রেফতারের কারণ জানানো হয়েছে কি না এবং তার পছন্দের আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শের সুযোগ পেয়েছে কি না খতিয়ে দেখবেন। একই সঙ্গে এ বিষয়ে আসামি বা তার আইনজীবীর বক্তব্য শুনবেন।
(ঘ) জিজ্ঞাসাবাদের আগে আসামির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে এবং তার রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে দিতে হবে।
(ঙ) শুধু তদন্তকারী কর্মকর্তাই জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আসামিকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে। আসামি নির্যাতনের অভিযোগ আনলে, ম্যাজিস্ট্রেট তৎক্ষণাৎ তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাবেন। তাতে নির্যাতনের প্রমাণ মিললে ম্যাজিস্ট্রেট তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩৩০ ধারায় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
(চ) পুলিশ হেফাজতে বা কারাগারে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাতে হবে। তখন তিনি বিষয়টি তদন্ত ও মৃত ব্যক্তির ময়নাতদন্ত করবেন।
(ছ) তদন্তে কারা বা পুলিশ হেফাজতে আসামির মৃত্যুর বিষয়টি প্রমাণিত হলে, ম্যাজিস্ট্রেট মৃত ব্যক্তির আত্মীয়ের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তা তদন্তের নির্দেশ দেবেন।
ওই রায়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা ও রিমান্ডবিষয়ক ১৬৭ ধারা সংশোধনসহ ৬ মাসের মধ্যে উপরে উল্লিখিত ১৫ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সবটা কিতাবের গরু। রায়ের ১৮ বছর পরও ওই নির্দেশনার বাস্তবায়ন নেই।
নিরাশার এই বালুচরে, পরীমনির রিমান্ডের ঘটনায় উচ্চ আদালতের পদক্ষেপ আশা জাগাচ্ছে। এ ঘটনা নিশ্চিতভাবে দেশের বিচার প্রক্রিয়ায় সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। উচ্চ আদালতের এই হস্তক্ষেপ রিমান্ডের প্রয়োগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও ম্যাজিস্ট্রেটকে আগামী দিনে সতর্ক করবে। তাদের প্রচলিত আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনার প্রতি সজাগ ও শ্রদ্ধাশীল করবে। তাতে পরিশুদ্ধ হবে তদন্ত প্রক্রিয়া। পরিশুদ্ধ হবে বিচারব্যবস্থা। নিশ্চিত হবে নাগরিকদের মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার।
আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী রাগিব : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট