বৃহস্পতিবার , ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
  1. অপরাধ
  2. অর্থনীতি
  3. অস্ট্রেলিয়া
  4. আন্তর্জাতিক
  5. আফ্রিকা
  6. আবহাওয়া
  7. আমেরিকা
  8. আয়ারল্যান্ড
  9. ইউক্রেন
  10. ইউরোপ
  11. ইতালি
  12. কানাডা
  13. খেলাধুলা
  14. গ্রাম বাংলা
  15. চিত্র বিচিত্র

সৌদি আরবে কাঁদছে আবুল কালাম, বাড়িতে কাঁদছে পারিবার

প্রতিবেদক
Probashbd News
সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২২ ১:১২ অপরাহ্ণ

Spread the love

আবুল কালাম ভূঁইয়া ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের এই যুবকের তিন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে গড়া সংসার চলছিল মোটামুটি সুখেই। গত বছরের শেষ দিকে উপজেলার রামদী ইউনিয়নের মধ্য তারাকান্দি গ্রামের দুই ভাই আবদুল মান্নান ও আবদুল হান্নান সৌদি আরব যাওয়ার প্রস্তাব দেন তাঁকে। একই গ্রামের হওয়ায় মিষ্টি কথায় ভুলে সেই ফাঁদে পা দেন কালাম। বিভিন্ন বেসরকারি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান (এনজিও) এবং সুদে টাকা খাটানো ব্যক্তিদের কাছ থেকে ঋণ করে পাঁচ লাখ টাকা তুলে দেন মান্নান ও হান্নানকে। এক পর্যায়ে সৌদি আরব যান তিনি। কথা ছিল ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা বেতন পাবেন মাসে। কিন্তু ৯ মাসেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে বৈধভাবে কাজ করার অনুমতি মেলেনি।

ওই সময় থেকেই বদ্ধ ঘরে মানবেতর জীবন কাটছে কালামসহ অর্ধশতাধিক যুবকের। তাঁদের প্রত্যেকেই মান্নান ও হান্নানের কথার ফাঁদে পড়ে ভবিষ্যৎকে ফেলেছেন অনিশ্চয়তায়। বিপাকে গ্রামের বাসিন্দারাও। গত বুধবার মোবাইল কলিং অ্যাপ ইমোর মাধ্যমে সৌদি আরবের রিয়াদে থাকা ভুক্তভোগী তিনজনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিনিধির। তাঁরা হলেন- মনোহরপুর গ্রামের আমান উল্লাহ, মধ্য তারাকান্দির আবুল কালাম ভূঁইয়া ও রুবেল মিয়া। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, বিভিন্ন সময়ে নানা পরিত্যক্ত ভবনে রাখা হচ্ছে তাঁদের। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় একটি পরিত্যক্ত ভবন থেকে বের করে দেওয়ার পর দালালদের লোকজন এসে রিয়াদের আল হাবীব হাসপাতালের কাছের আরেকটি পরিত্যক্ত ভবনে নিয়ে যায়। বর্তমানে সেখানেই আছেন অর্ধশতাধিক ভুক্তভোগী। কথা বলার সময় বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন তাঁরা।

বিভিন্ন মসজিদ থেকে সংগ্রহ করে দু-তিন দিন পরপর খাবার খাচ্ছেন বলে জানান আমান উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘কষ্টের সব কথা বাড়িত জানাই না, বাবা শুনলে স্ট্রোক করতে পারে।’ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানান তাঁরা।

বুধবার সরেজমিন মনোহরপুর গ্রামে গেলে আমান উল্লাহর বাবা হারিছ মিয়া বলেন, ‘জীবনে পোলাডারে কোনো কষ্ট দিছি না। কত ক্ষতি কইরা বিদেশ পাঠাইলাম। অহন খাওনের কষ্ট করতাছে। আপনেরা হেরারে বাড়িতে আনার বেবস্থা করেন।’

প্রবাসে স্বামী রয়েছেন দুর্ভোগে আর দেশে ঋণের কিস্তির চাপে হতাশায় পড়েছেন স্ত্রী। আবুল কালাম ভূঁইয়ার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার (৩০) বলেন, “হেরা (হান্নান ও মান্নান) আইয়া কইছিল, ‘দেশে কষ্ট কইরা কত চলবা? পাঁচ লাখ ট্যাহা দেও, বিদেশ গেলে ৬০-৭০ হাজার ট্যাহা বেতন পাইবা।” তিনি বলেন, সুদের ওপর টাকা নিয়ে এবং এনজিও থেকে ঋণ করে স্বামীকে বিদেশে পাঠিয়েছেন। এখন সবাই টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে। সৌদি আরবে অবস্থানরত হান্নান ও মান্নান ফোন ধরছেন না। বাধ্য হয়ে আবদুল মান্নানের ইমো নম্বরে মেসেজ পাঠিয়েছে তিন মেয়েসহ আত্মহত্যারও হুমকি দিয়েছেন। তাঁর এমন মেসেজেরও কোনো উত্তর আসেনি শুক্রবার পর্যন্ত।

আরেক ভুক্তভোগী পশ্চিম তারাকান্দি গ্রামের মহরম আলীর স্ত্রী সাথী আক্তার বলেন, ‘পোলাপানরারে নিয়া কষ্ট করতাছি। স্বামীর কষ্টের কথা শুনলে আমরার (আমাদের) কষ্টের কথা মনে তাহে না।’

তারাকান্দি গ্রামের খোকন মিয়ার স্ত্রী গৃহবধূ ফারজানা আক্তার ববি (৩২) বলেন, “আমার স্বামী সিএনজি চালাইতো। একদিন হান্নান আইসা বলে, ‘গাড়ি চালাইয়া কত কামাইবা? বিদেশ (সৌদি আরব) গেলে ৫০-৬০ হাজার টাকা বেতন পাইবা।”

খোকন মিয়া সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ নিজের তিনটি গরু বিক্রি করেন। বন্ধক দেন জমি। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে সেই টাকায় সৌদি আরব যান। ফারজানা আরও বলেন, ৪ মেয়ে ও ৩ ছেলেকে নিয়ে খাদ্যের কষ্ট ও ঋণের চাপে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, কয়েক যুগ ধরে সৌদি আরব থাকেন আবদুল মান্নান। তাঁর ছোট ভাই আবদুল হান্নান এলাকায় পোলট্রি ফিডের ব্যবসা করতেন। বছরখানেক আগে ভাইয়ের সহায়তায় তিনি বিদেশে লোক পাঠানো শুরু করেন। গত বছর মান্নান ছুটিতে দেশে এসে আশপাশের কয়েক গ্রামের কর্মজীবী অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে বেশি বেতনে কাজ দেওয়ার প্রলোভন দেখান। তাঁদের কথায় বেশ কয়েকজন পাঁচ লাখ করে টাকা দেন। ছুটি শেষে মান্নান চলে গেলেও লোক সংগ্রহ করতে থাকেন হান্নান। বছরখানেক আগে অর্ধশতাধিক মানুষকে সৌদি আরব নিয়ে যাওয়ার পর হান্নানও চলে যান। যাঁরা এ দুই ভাইয়ের মাধ্যমে সে দেশে গেছেন, তাঁদের মধ্যে উপজেলার পশ্চিম তারাকান্দি গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম, আবু ছিদ্দিক, মহরম আলী, জাফরাবাদ গ্রামের হিমন মিয়া, মনোহরপুর গ্রামের আমান উল্লাহ, মোবারক মিয়া, লক্ষ্মীপুর মধ্যপাড়া গ্রামের সুরুজ মিয়া, মধ্য তারাকান্দি গ্রামের আবুল কালাম ভূঁইয়া, বাসিকুল ও রুবেল মিয়া, কান্দুলিয়া গ্রামের হাসান মিয়া, চর কামালপুর গ্রামের হুমায়ুন কবিরের নাম জানা গেছে।

বাজরা বাসস্ট্যান্ডের ফিড ব্যবসায়ী মো. জুয়েল মিয়া বলেন, ‘ফিডের সাব-ডিলার ছিল আবদুল হান্নান। তার কাছে আমি সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা পাই। তা পরিশোধ না করেই সে বিদেশ চলে গেছে।’

তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে আবদুল মান্নান স্থানীয় একজন গণমাধ্যমকর্মীকে মোবাইল ফোনে বলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে দু’জনকে দেশে পাঠাতে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে তাঁকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যাঁরা কাজ করবেন, তাঁদের কাজ দেওয়া হবে। যাঁরা দেশে চলে যেতে চান, তাঁদের ফেরত পাঠাবেন।

এদিকে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভুক্তভোগীদের একটি ভিডিওচিত্র ছড়িয়ে পড়ে। এতে নিজেদের দুর্দশার করুণ চিত্র তুলে ধরেন তাঁরা। দুঃসহ জীবন থেকে দেশে ফিরিয়ে আনতে তাঁরা স্থানীয় সংসদ সদস্য নাজমুল হাসান পাপনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
রামদী ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জামাল উদ্দিন সমকালকে বলেন, তিনি এসব বিষয়ে অবগত আছেন। ওই প্রবাসীদের বাড়ির লোকজনও ব্যাপক দুর্ভোগে পড়েছেন।

রামদী ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ আলাল উদ্দিন বলেন, আবদুল মান্নান ও আবদুল হান্নান আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অর্ধশতাধিক লোককে সৌদি আরব নিয়ে গেছেন বলে শুনেছেন। খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, বেশিরভাগ লোকই ঋণ করে গেছেন।

কুলিয়ারচর থানার ওসি মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা বলেন, ওই প্রবাসীদের বিষয়ে তিনি নজর রাখছেন। এটিকে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিষয় উল্লেখ করে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান। ওসি আরও বলেন, থানায় অভিযোগ এলে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন।

কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, সৌদি আরবে যাওয়া যুবকদের সমস্যার বিষয়টি শুনেছেন।

এসব বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের প্রবাসী কল্যাণ শাখার সিনিয়র সহকারী কমিশনার বাবলু সূত্রধর শনিবার সমকালকে বলেন, ১৫-১৬ জন প্রবাসীর অভিভাবকের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

সর্বশেষ - প্রবাস

Translate »