স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রমে এ পর্যন্ত তিনটি পূর্ণ এবং একটি আংশিক আবর্তন সম্পন্ন হয়েছে।
প্রথম আবর্তনের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা হয়েছিল প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির জন্য ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ সালে, যা প্রাথমিক স্তরে ১৯৭৮ সালে এবং মাধ্যমিক স্তরের সর্বনিম্ন উপস্তর-নিম্নমাধ্যমিকে (ষষ্ঠ শ্রেণিতে) ১৯৮১ সালে, মধ্য-মাধ্যমিকে (নবম শ্রেণিতে) ১৯৮৩ সালে এবং মাধ্যমিক স্তরের সর্বোচ্চ উপস্তর-উচ্চমাধ্যমিকে (একাদশ শ্রেণিতে) সে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয় ১৯৮৫ সালে। প্রথম আবর্তনের এই শিক্ষাক্রম ছিল প্রধানত বিষয়ভিত্তিক (Content-based)।
দ্বিতীয় আবর্তনের শিক্ষাক্রম উন্নয়ন মূলত প্রথমবার প্রণীত শিক্ষাক্রমের পরিমার্জন। এবারের শিক্ষাক্রম ছিল উদ্দেশ্যভিত্তিক (Objective-based) এবং প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রমকে ‘আবশ্যকীয় শিখনক্রম’ নাম দিয়ে প্রথমবারের মতো যোগ্যতাভিত্তিক (Competency-based) আদলে সাজানো হয়। প্রাথমিক স্তরে ওই শিক্ষাক্রম ১৯৯২ সালে, নিম্নমাধ্যমিক ও (মধ্য)মাধ্যমিক উভয় উপস্তরে তা একই সঙ্গে ১৯৯৬ সালে এবং উচ্চমাধ্যমিক উপস্তরে তা ১৯৯৮ সালে বাস্তবায়ন শুরু হয়।
তৃতীয় আবর্তনের শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয় শুধু প্রাথমিক ও মধ্য-মাধ্যমিক (৯ম-১০ম শ্রেণি) উপস্তরে। প্রাথমিক স্তরে এটি বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০০৩ সালে; কিন্তু মাধ্যমিকের নিম্ন ও উচ্চ উভয় উপস্তর বাদ দিয়ে শুধু মধ্য-মাধ্যমিক উপস্তরের জন্য পরিমার্জিত ‘একমুখী’ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা যায়নি।
শিক্ষাক্রমের চতুর্থ আবর্তনটি ছিল সম্পূর্ণ এবং এর সিংহভাগ পরিমার্জন ২০১১ সালে সম্পন্ন হলেও পরের বছর একে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২’ নামে অনুমোদন করা হয়। অধিকাংশ শ্রেণিতে এর বাস্তবায়ন একই সঙ্গে শুরু হয় ২০১৩ সালে। প্রধানত উদ্দেশ্যভিত্তিক এই শিক্ষাক্রম প্রাথমিক স্তরে তৃতীয়বারেরটির ঠিক ১০ বছর পরে এবং মাধ্যমিক স্তরের তিন উপস্তরে দ্বিতীয় বারেরটির (তৃতীয়বারেরটি বাস্তবায়িত হয়নি) ১৭ বছর পরে বাস্তবায়ন করা হয়।
কিন্তু এবার শিক্ষাক্রমের পঞ্চম আবর্তনের উন্নয়ন বা চতুর্থবারের পরিমার্জন শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালে, চতুর্থ আবর্তনের মাত্র ৭-৮ বছর পর। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত দ্বিবিধ- ১. বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রাথমিকের মতো মাধ্যমিক স্তরের সব উপস্তরের শিক্ষাক্রম যোগ্যতাভিত্তিক আদলে সাজানো এবং ২. টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (Sustainable Development Goals) অর্জন করানো।
পঞ্চম আবর্তন এখনো পরিমার্জনাধীন। শিক্ষাক্রমকে এর রূপরেখায়ই গাওয়া হচ্ছে ‘আমূল পরিবর্তনে’র গীত। বাস্তবে শিক্ষাক্রমে আমূল পরিবর্তন আনা যায় না, এর চেষ্টা করাও অন্যায়। ৩০০ বছর আগে বিজ্ঞানী নিউটনের করা একটি উক্তি স্মর্তব্য। তিনি বলেছেন, If
I have seen something further than others, it is by standing upon the shoulders of giants. আগের লোকদের কাঁধ/ঘাড় পর্যন্ত করা উন্নয়ন অস্বীকার করে আবার পায়ের তলা থেকে কাজ শুরু করা আহাম্মকের কর্ম। প্রস্তাবিত রূপরেখায় পরিমার্জন একটু আগে শুরু করার প্রধান উদ্দেশ্য-টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে ব্যাখ্যা করা হয়নি। আর এই রূপরেখা-দলিলে বিভিন্ন বিষয়ের ধারণা (Concept), ভাষা, এমনকি ফরমেটিংয়ে ভুলের মাত্রা দেখে এটি প্রস্তুতকারীদের আন্তরিকতা ও যোগ্যতা সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন জাগে।
দেশে ২০০৪-২০০৫ সালে নবম-দশম শ্রেণিতে শাখাবিভাজন বর্জন করে ‘একমুখী শিক্ষা’ প্রবর্তনের প্রচেষ্টা সফল হয়নি। পরিমার্জনাধীন শিক্ষাক্রমে নবম-দশম শ্রেণিতে পুনরায় শাখাবিহীন এক ধারার শিক্ষা প্রবর্তন বাস্তবে সম্ভব কি না, সে প্রশ্নও রয়ে যাচ্ছে। একটি বিষয়ের চটকদার নাম দেওয়া হচ্ছে ‘ভালো থাকা’; তাহলে অন্যান্য বিষয়ের উদ্দেশ্য কি খারাপ থাকা? তাছাড়া বিভিন্ন মূলায়ন প্রক্রিয়া ও পরীক্ষার নম্বর বণ্টনে যেসব প্রস্তাব করা হয়েছে তা প্রচুর বিচারবিশ্লেষণের দাবি রাখে।
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা : শিক্ষা গবেষক এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক (সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার)