হোজ্জাতুল ইসলাম
গত ৮ জুলাই ঢাকা জেলা সিভিল সার্জন স্বাক্ষরিত এক আদেশে সরকারি হাসপাতালগুলো থেকে কোভিড-১৯ মহামারিকালে গণমাধ্যমের কাছে রোগী ও স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক তথ্য আদান-প্রদানে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। মহামারি নিয়ন্ত্রণে অবাধ তথ্যপ্রবাহের সুযোগ কাজে লাগানোর পরিবর্তে কেন এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, এর কোনো যৌক্তিক কারণ আমরা খুঁজে পাই না। রাষ্ট্রীয় ও বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে বিভিন্ন সময় জনসাধারণসংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ না করার নির্দেশনা জারি করা হয়। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো থেকে প্রচারিত তথ্য পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়ার নজিরও নিকট অতীতে রয়েছে। আমরা এমন এক সময়ে রয়েছি যখন কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য প্রকাশিত হলে সেই অনিয়ম বা অভিযোগ তদন্ত করার পরিবর্তে কীভাবে সেই তথ্য গণমাধ্যমে পৌঁছাল সেটির তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণের কাজে কর্তৃপক্ষগুলোকে অতিউৎসাহী হতে দেখা যায়। তথ্য গোপন বা নিয়ন্ত্রণের এ ধরনের অপচেষ্টা দিন দিন প্রকট হচ্ছে।
অথচ প্রায় এক যুগ আগে জনগণের তথ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের প্রারম্ভিকায় দুর্নীতি হ্রাস ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তথ্যের অবাধ প্রবাহের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকের চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতাকে অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ জনগণের তথ্য অধিকার। এ ছাড়া জাতিসংঘের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সনদে এবং জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী সনদেও একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিকের তথ্য অধিকারের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। হালের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) ১৬-তে বলা হয়েছে, টেকসই উন্নয়নসহ সর্বস্তরে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে তথ্যে প্রবেশগম্যতা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক; এতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে তথ্য অধিকার আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগের আহ্বান জানানো হয়েছে। এতসব বিধিবিধান-আহ্বান সত্ত্বেও তথ্য নিয়ন্ত্রণ বা গোপনের অপচেষ্টাকে দমন করা যাচ্ছে না।
প্রকৃত অর্থে একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রায় তথ্যের অবাধ প্রবাহ গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করে। জনগণ ক্ষমতায়িত না হলে কোনো সামষ্টিক উন্নয়ন অর্জন সম্ভব হয় না। প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন মৌলিক চাহিদা ও অধিকারের নিশ্চয়তার পাশাপাশি তথ্যই পারে জনগণকে ক্ষমতায়িত করতে। এ জন্য মূল যে উদ্যোগটি তথ্যের প্রাপ্যতাকে সহজলভ্য করতে পারে সেটি হলো, প্রতিষ্ঠানের স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ। দেশে তথ্য প্রকাশের জন্য সুস্পষ্ট বিধান [তথ্য অধিকার (তথ্য প্রকাশ ও প্রচার) প্রবিধানমালা, ২০১০)] এবং নির্দেশিকা (স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ নির্দেশিকা, ২০১৪) বলবৎ থাকলেও সরকারি-বেসরকারি কোনো ধরনের প্রতিষ্ঠানই এর যথার্থ প্রতিপালন করছে না। এমন অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা জনগণের তথ্য অধিকার বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার অথচ নিজেদের প্রতিষ্ঠানে কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিতে বিজ্ঞাপিত পদের বিপরীতে বেতনের অঙ্কটা উল্লেখ করতে নারাজ! তথ্য প্রকাশের দায়িত্ব শুধু রাষ্ট্রের নয়, দায়িত্ব প্রতিটি অংশীজনের। প্রত্যাশিত পরিবেশের চর্চা নিজেদের মধ্যে না করে অন্যের ক্ষেত্রে সেটি দাবি করা অন্যায়।
সম্প্রতি টিআইবি পরিচালিত ‘তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ চর্চার মূল্যায়ন’ শীর্ষক এক গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশে বেসরকারি সংস্থার চেয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ এগিয়ে। প্রথম ১০টি অবস্থানে রয়েছে ৬৯টি প্রতিষ্ঠান, যাদের প্রাপ্ত স্কোর ৩৩-৪২ (৫০-এর মধ্যে); এর মধ্যে এনজিও নেই। এমনকি গবেষণার মানদণ্ডে কোনো এনজিও-ই সন্তোষজনক স্কোর পায়নি; এনজিওগুলোর মধ্যে প্রথম ১০টি অবস্থানে রয়েছে ১৯টি প্রতিষ্ঠান, যাদের প্রাপ্ত স্কোর ৭-২২!
সুতরাং, শুধু যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক কারণে তথ্য গোপন করা হয়, তা নয়; বেসরকারি পর্যায়ে এটি বিভিন্ন ধরনের অযাচিত স্বার্থ সংরক্ষণের হাতিয়ার হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার ঘাটতি কারণ হিসাবে প্রতীয়মান হলেও তথ্য অধিকারের প্রেক্ষাপটে এবং দাতাগোষ্ঠীর অর্থায়নে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ কারণের যৌক্তিকতা মেনে নেওয়া কঠিন। অনেক প্রতিষ্ঠানেরই তথ্য উন্মুক্তকরণ নীতিমালা নেই। কেউ তথ্যপ্রাপ্তির আবেদন করলে প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের মনস্তত্ত্বে প্রথমেই যে বিষয়টি কাজ করে তা হলো, কেন বা কী উদ্দেশ্যে তথ্যটি চাওয়া হয়েছে? কে আবেদন করেছে? তথ্য নিয়ে কী করা হবে? সরল মনে সংক্ষিপ্ততর সময়ে তথ্য প্রদানের মানসিকতা খুব কম প্রতিষ্ঠানই ধারণ করে। তথ্য অধিকার আইনকে প্রত্যাশিত মাত্রায় কার্যকর করতে হলে তথ্য গোপনের এ মানসিকতা ভাঙতে হবে।
নাগরিক পর্যায়ে বর্তমানে দেশের তথ্যব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ২০০৬ সালে প্রণীত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন এবং ২০১৮ সালের ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে। ভার্চুয়াল স্পেসে কোনো তথ্য প্রকাশ করতে চাইলে এখন মানুষের মাথায় প্রথমেই আঘাত করে এ দুটি জনবিরোধী আইন। তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারে ক্ষমতায়িত জনগণ তথ্য ব্যবহারের পরিসরে এসে সংকুচিত হয়ে পড়ে। অনির্দিষ্ট ‘অপব্যবহারে’র বৃহৎ সংজ্ঞায় জনগণ নিজেদের হারিয়ে ফেলে, তথ্যে ক্ষমতায়িত হওয়ার সে ক্ষমতা কার্যত কোনো কাজে লাগে না। এ জন্য তথ্য অধিকার আইনটিকে আরও শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই, যেন এ আইনই দেশের তথ্য পরিসরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
তথ্য অধিকার আইনকে শক্তিশালী করতে গত ১২ বছরে এর বিভিন্ন অর্জন, চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা পর্যালোচনা করা জরুরি। তথ্যে জনগণের অভিগম্যতা সৃষ্টি ও ক্ষমতায়ন হয়েছে সত্য। কিন্তু তথ্যপ্রাপ্তির আবেদনের কারণে আবেদনকারীকে চাঁদাবাজির মামলায় অভিযুক্ত করানোর পথ রুদ্ধ করতে হবে। আইনের মধ্যে এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যেন তথ্য চাওয়ার কারণে নিকট ভবিষ্যতে তথ্যের আবেদনকারীকে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হতে না হয়। তথ্য কমিশনের ভূমিকা শুধু তথ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। তথ্যের আবেদনকারীর নিরাপত্তার বিধান করে একদিকে যেমন জনগণকে সাহস দিতে হবে, অন্যদিকে তথ্য প্রদান ও স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহ জোগাতে হবে।
তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগের ফলে সেবাদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় নাগরিক সনদ ও অভিযোগ বাক্স স্থাপিত হয়েছে। এই নাগরিক সনদ ও অভিযোগ বাক্স শুধু প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত সৌন্দর্যবর্ধক উপকরণ হিসাবে যেন দৃশ্যমান না থাকে, সে ব্যবস্থা চালু করতে হবে। তথ্যপ্রাপ্তির আবেদন প্রক্রিয়াটি লিখিত হওয়ায় দরিদ্র ও তৃণমূল মানুষের পক্ষে তা প্রতিপালন করা অসাধ্য একটি কাজ। তারা আইন মেনে তথ্যের আবেদন করতে আগ্রহী হয় না, বরং সরাসরি তথ্যপ্রাপ্তির প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি। এ জন্য নাগরিক সনদ নিয়মিত হালনাগাদকরণ ও সহজবোধ্য ভাষায় প্রয়োজনীয় তথ্যে সহজে দৃশ্যমান করে উপস্থাপন করতে হবে। একইভাবে অভিযোগ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়াকে করতে হবে পক্ষপাতহীন ও প্রভাবমুক্ত। তাহলেই কেবল তথ্যের প্রায়োগিকতাকে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতি-অনিয়ম প্রতিরোধ করে প্রতিষ্ঠানগুলো সেবাবান্ধব হয়ে উঠতে পারবে।
করোনা মহামারি আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের অনেক অনুকরণীয় উদ্যোগ ও চর্চাকে স্তিমিত করে দিয়েছে। এর মধ্যে গণশুনানি উল্লেখযোগ্য। লকডাউনের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর সরাসরি সেবাপ্রদান ব্যবস্থা বন্ধ ছিল। ফলে সেবাপ্রত্যাশী জনগণের সঙ্গে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের দূরত্ব বেড়েছে। এ ঘাটতি লাঘবে প্রতিষ্ঠানের তথ্য স্বপ্রণোদিতভাবে প্রকাশের উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য তথ্য কমিশন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে সমন্বিত প্রচারমূলক কার্যক্রমের উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের উচিত হবে স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশের নির্দেশিকা মেনে প্রতিষ্ঠানের সেবাসংক্রান্ত তথ্য বিভিন্ন মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া। তথ্য প্রকাশ ও প্রচারে প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার করতে হবে। জনগণের কাছে তথ্য পৌঁছাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। তথ্য অধিকার আইন ফলপ্রসূ করা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা ও সঙ্গতি পর্যবেক্ষণের জন্য তথ্য কমিশনের সক্ষমতা ও তদারকি বাড়াতে হবে। তদারকি কার্যক্রমে নাগরিক সমাজ ও জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। যেভাবেই হোক, জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ করতে হবে। তথ্যের গোপনীয়তা কোনো সমাধান নয়; বরং তথ্য গোপন করা বা এ ধরনের যে কোনো নির্দেশনাকে অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯-এ প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে।
লেখক: অ্যাসিস্ট্যান্ট কো-অর্ডিনেটর, সিভিক এনগেজমেন্ট, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)