‘আমি ঝামেলায় পড়ছি, আমাকে পুলিশে ধরছে, এখান থেকে ছাড়া পেতে বাংলা ৩০ হাজার টাকা লাগবে। কী হলো কিছু বলছো না কেন, আমার হাতে সময় খুব কম, কতক্ষণ লাগবে? তাড়াতাড়ি জানাও, আমাকে খুব মারছে, বিকাশ পারসোনাল নম্বর ০১৮৯২.., ৩০ হাজার ৬০০ টাকা, তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দাও, এখন না হলে পুলিশ এক বছরের জন্য জেল দেবে’।
গ্রিসপ্রবাসী বাংলাদেশি ইয়াকুবের ব্যবহৃত ইমো থেকে শুক্রবার (৯ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে দেশে স্ত্রীর ইমোতে এমনই মেসেজ পাঠানো হয়। এভাবেই একের পর এক আবেগী মেসেজ দেওয়া হয় ইয়াকুব আলীর স্ত্রীর ফোনে। মোবাইল কাছে না থাকায় তাৎক্ষণিক মেসেজগুলো দেখেননি প্রবাসীর স্ত্রী। এক পর্যায়ে ইমো থেকে কোনো উত্তর না আসায় ইয়াকুবের ইমো থেকেই কল দেওয়া হয় তার স্ত্রীকে।
কল রিসিভের পর জনৈক এক ব্যক্তি বলেন, ‘আপনার স্বামীকে পুলিশে ধরেছে তাকে ছাড়াতে চাইলে তাড়াতাড়ি ওই নম্বরে ৩০ হাজার ৬০০ টাকা বিকাশে পাঠান, নয়তো এক বছরের জন্য জেলে দেবে।’ এ কথা বলে কল রেখে দেন ওই ব্যক্তি। এসব কথা শুনে এবং স্বামীর মোবাইল থেকে পাওয়া মেসেজ দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন প্রবাসী ইয়াকুবের স্ত্রী।
তখন তিনি সঙ্গে সঙ্গে গ্রিসে থাকা তাদের অন্য আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন তার স্বামী ইমো হ্যাকারের কবলে পড়েছেন। পরে তিনি হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়ে নিশ্চিত হন তার স্বামীকে পুলিশ ধরেনি, তিনি ভালো আছেন এবং তার ইমো হ্যাকের কথা জানান।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে গ্রিসপ্রবাসী ইয়াকুব আলী প্রতারণার শিকার হওয়ার কথা জানান।
কীভাবে হ্যাক হলো ইমো? এ প্রসঙ্গে প্রবাসী ইয়াকুব আলী বলেন, গত ৮ সেপ্টেম্বর গ্রিস সময় সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটে ‘বিডি অ্যাম্বাসি’ লেখা একটি ইমো থেকে কল আসে ইমোতে। কল দিয়ে এক লোক বলে আপনার নম্বর বন্ধ কেন? আপনাকে অনেকবার কল দিয়েও পাচ্ছি না। তখন আমি বলি, আমার সিম তো চালুই আছে, তখন অপরপ্রান্ত থেকে বলে তাহলে লাইনে থাকেন আমি কল দিয়ে দেখি।
‘এ কথা বলে +১৩১৯-৫৮২… নম্বর থেকে কল দেওয়া হয় মোবাইলে। তখন আমাকে বলে এখন তো কল যাচ্ছে, আমি বললাম হ্যাঁ এখন কল এসেছে, তখন সে বলে আমার কোনো নম্বর থেকে কল গিয়েছে লাস্টে কত? তখন আমি সরল মনে লাস্টে ৪ সংখ্যা বলে দেই। এরপর ভালো থাকেন পরে কল দিচ্ছি বলে রেখে দেয়।’
ইয়াকুব জানান, এরপরই তিনি বুঝতে পারেন তিনি ইমো হ্যাকারের কবলে পড়েছেন। তার ইমো থেকে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুসহ বিভিন্ন মানুষের কাছে মেসেজ দিয়ে টাকা চাওয়া হয়। এমন কি তাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে বলেও তার স্ত্রীর কাছে মেসেজ ও কল দেয় প্রতারক চক্রটি। ভয়ে তিনি ইমো ডিলিট করে দেন। তার পরিচয়ে কারো কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছি কিনা তা এখনো জানতে পারেননি ইয়াকুব।
এভাবেই প্রবাসীদের বোকা বানিয়ে ইমো অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র। চক্রের সদস্যরা ইমোর মাধ্যমে প্রবাসীদের নম্বর সংগ্রহ করে পরে একটি ওয়ানটাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) পাঠিয়ে প্রবাসীদের কাছ থেকে কৌশলে বিভিন্ন অজুহাতে ওটিপি নিয়ে সেই আইডি হ্যাক করে।
প্রবাসীদের তারা বেশিরভাগ সময়ই দূতাবাসের কর্মকর্তা পরিচয়ে কল দেন। ইমো অ্যাকাউন্টটি তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলেই সাধারণত ওই অ্যাকাউন্টধারীর আত্মীয়-স্বজনের কাছে কল করে বা মেসেজ পাঠিয়ে বিপদে থাকার কথা বলে টাকা ধার চায় প্রতারকরা।
এমনকি চক্রটির ফাঁদে পড়েছেন প্রবাসে থাকা অনেক নারীও। বহু নারী ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েছেন। ইমোর গোপন ছবি ও রেকর্ড করা কণ্ঠ ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে প্রতারকরা হাতিয়ে নিচ্ছে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ। আবার অনেকেই প্রতারকদের কল পেলেই বুঝতে পারেন, তাই তাদের ফাঁদে আটকাতে পারে না। তাদেরই একজন গ্রিস প্রবাসী স্বপন তালুকদার। তিনি অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন ইমো হ্যাকিং প্রতারণার ফাঁদ থেকে।
স্বপন তালুকদার বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাসের নাম দিয়ে একটি ইমো আইডি ব্যবহার করে নতুন করে ফাঁদ বা সুকৌশল অবলম্বন করে গ্রিস প্রবাসী বাংলাদেশিদের ফাঁদে ফেলার এটি একটি নতুন কৌশল অবলম্বন করছে একটি প্রতারক চক্র। সম্প্রতি আমার ইমোতে ‘বিডি অ্যাম্বাসি’ নামে কল আসে। আমি কল রিসিভ করে সালাম দিলাম, ওপাশ থেকেও প্রতারক চক্রের একজন আমাকেও সালাম দিলো। খুব সুন্দরভাবে কথা বলছিল, মনে হচ্ছিল উচ্চশিক্ষিত কারও সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল নিশ্চয়ই বাংলাদেশ দূতাবাসের কোনো একজন কর্মকর্তা হতে পারেন।
‘কথা শেষ হতে না হতেই দেখতে পাই আমার অন্য আরেকটি মোবাইলে কল আসছে; কল রিসিভ করলাম এবং শুনতে পেলাম ইমোতে যে লোক আমার সঙ্গে কথা বলছেন বা এখনো লাইনে আছেন তিনিই হুবহু তারই কণ্ঠ এবার আমাকে বলছেন স্যার আপনার সিম নম্বরে একটা কল গেছে, আমি বললাম হ্যাঁ আমি কল দেখতে পাচ্ছি। সাথে সাথে তিনি মাশাল্লাহ বলে আমাকে বললেন স্যার আপনার মোবাইলে যে নম্বরটা দেখতে পাচ্ছেন সেই নম্বর থেকে একদম শেষের দুটি নম্বর আমাকে বলুন স্যার। তখন আর আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে তিনি প্রতারক। এক পর্যায়ে আমি তাকে বললাম, আমি এতই বোকা নয় যে আপনার ফাঁদে পা দেবো। এ কথা শুনে হঠাৎ লাইন কেটে দিলো প্রতারক।’
ইমো হ্যাকের বিষয়ে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা প্রবাসীদের আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলছেন, মোবাইল ফোনে কোনো ওটিপি বা কোড পাঠালে তা কাউকে জানানো থেকে বিরত থাকুন। প্রতারকরা বিভিন্ন পরিচয়ে কল দিয়ে কোড জানতে চাইবে, তা দেবেন না। আত্মীয়-স্বজন পরিচয়ে কেউ টাকা চাইলে বিকল্প নম্বর বা অন্য কোনোভাবে যোগাযোগ করে কথা বলে আগে নিশ্চিত হবেন।
আপনার ইমো অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে কিনা বা হ্যাক হলে হ্যাকারের তথ্য ‘অ্যাকাউন্ট অ্যান্ড সিকিউরিটি’ অপশনে ঢুকে ম্যানেজ ডিভাইসে ক্লিক করলেই বুঝতে পারবেন। দূতাবাসের নাম ব্যবহার করে প্রতারণার বিষয়ে অবগত আছে এথেন্সে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস। তারা এরই মধ্যে সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় ‘প্রবাসী ভাই-বোনদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, সম্প্রতি গ্রিস প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে ইমো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ‘অ্যাম্বাসি’ নামে একটি ভুয়া আইডি থেকে কল আসছে। এই কলের মাধ্যমে জানানো হচ্ছে যে প্রবাসীদের তথ্যাদি হালনাগাদ করার জন্য ফোন করা হয়েছে এবং প্রবাসী ব্যক্তির মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে একটি কোড নম্বর যাবে। সেই কোড নম্বরটি তাদের জানানোর জন্য বলা হচ্ছে।
এ বিষয়ে সতর্ক করা যাচ্ছে যে- বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে এ রকম কোনো ফোন করা হচ্ছে না। দূতাবাস থেকে ফোন করে কখনো কোনো কোড চাওয়া হয় না। প্রবাসী ভাই-বোনদের জন্য স্মার্টফোন একটি অতি জরুরি ব্যক্তিগত তথ্যভাণ্ডার। স্মার্ট ফোনের মাধ্যমেই অনেকে ব্যাংকিং ও অন্যান্য আর্থিক লেনদেন করে থাকেন।
মোবাইল ফোনে অনেক ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্যও থাকে, যা অন্য কারও হাতে গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ক্ষতি হতে পারে। এসএমএসের মাধ্যমে ফোন কোড সংগ্রহ করে কোনো অসাধু চক্র স্মার্টফোন হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্যাদি নিয়ে নিতে পারে এবং প্রবাসীদের আর্থিক ও সামাজিকভাবে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। তাই এ বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করুন। আপনার নিজের নিরাপত্তার জন্য আপনার পাসওয়ার্ড বা কোড নম্বর কারও সঙ্গে কখনো শেয়ার করবেন না।