আমাদের লক্ষ-কোটি প্রবাসী শ্রমিক পরিবার-পরিজন ছেড়ে প্রবাসে এক অন্তহীন জীবন সংগ্রামে নিয়োজিত। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া, অসংখ্য প্রবাসীর আয় যৎসামান্য। দালালের মাধ্যমে বিদেশ যাওয়া বেশিরভাগ আবার ঋণগ্রস্ত। মধ্যপ্রাচ্যের অসংখ্য শ্রমিক ভাইদের আয় দেশি মুদ্রায় ২০ হাজার টাকার কম-বেশি। ইউরোপ-আমেরিকা অনেকের কাছে স্বপ্নের মতো। কিন্তু আমরা কি জানি প্যারিসের রেল স্টেশনে ফুটপাতে যে যুবককে সিডি ক্যাসেট বিক্রি করতে দেখা যায় কিংবা রোমের রাস্তায় ফেরি করে সংবাদপত্র বিক্রি করা মধ্যবয়সী ব্যক্তি, অথবা নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস-এ ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করার মানুষগুলোর আয় কেমন? তাদের জীবনের কষ্ট, গল্পগুলো জেনেছি কখনো?
আমাদের লক্ষ-লক্ষ তরুণ-যুবক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গহীন, বিপৎসংকুল জঙ্গল পায়ে হেঁটে কিংবা উত্তাল সমুদ্র নৌকায় পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যায়, আমেরিকা যায়। তারা জানে এই দুর্গম যাত্রায় তাদের মৃত্যু হতে পারে। তারা জানে যে স্বপ্নের দেশে পৌঁছুলেও তারা কাগজপত্র-বিহীন বহু বছর কাটিয়ে দিতে হবে, স্বজনদের প্রিয় মুখটি দেখবে না। আমি প্যারিস-জেনেভা-লন্ডনের রাস্তায় এমন বহু যুবকের সন্ধান পাওয়া যায় যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা। যেকোনো উপায়ে সেখানে গিয়েছে। কেউ শিক্ষার্থী ভিসায়, কেউ সাংবাদিক, শিল্পী হিসেবে, কেউ কন্টেইনারে পাচার হয়ে।
যারা সৌভাগ্যবান তারা খুব দ্রুতই বৈধ কাগজপত্র ব্যবস্থা করে নেন। কিন্তু বহু যুবক “বৈধ” হওয়ার অপেক্ষায় জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেয়। অনেকের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন বছরের পর বছর ঝুলে আছে। আমরা কেবল দেশের জিডিপি-তে প্রবাসীদের অবদানের অংক গুনি। দেশের অর্থনীতির স্তম্ভ হিসেবে প্রবাসী শ্রমিকদের কথা বলি। কিন্তু বাংলাদেশের লক্ষ পরিবারে, পাড়ায়, মহল্লায়, গ্রামে জীবন থেকে নেওয়া প্রবাসীদের শৌর্য-বীর্যের অসংখ্য গল্পের কথা কি জানি?! তাদের আত্মত্যাগের করুণ ইতিহাস কি জানি? কোনো সাহিত্যিক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক কি তাদের কলমের তুলিতে এই বীরত্বকে, আত্মত্যাগকে ধারণ করেছে? সাহিত্য তো সময়কে ধারণ করার কথা। আমাদের সোনালী এই মানুষগুলোর জীবন-যৌবন-স্বপ্ন চুরি হয়ে যাওয়ার ইতিহাস কি তাদের কথামালায় উঠে এসেছে?