রান্নাঘর থেকে ঝনঝন করে কিছু একটা ভাঙার শব্দ কানে এলো। কাচের জগ বা গ্লাস কিছু একটা হবে। দৌড়ে গিয়ে দেখলাম, যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই! গত মাসেই এত শখ করে নিউমার্কেট থেকে দামি গ্লাসের এই জগটা কিনেছিলাম। যদি ভেঙে যায় এই ভয়ে ব্যবহারই করিনি। শোকেসেই ছিল। গতকাল ঈদের দিন বলে বের করেছিলাম। আর ভাঙবি তো ভাঙ, এই জগটাই ভাঙতে হলো?
দৈনিক ইত্তেফাকের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
রাগে, দুঃখে বুড়ি বুয়াটার ওপর অনেকক্ষণ রাগ ঝাড়লাম। বললাম, ‘দেখেশুনে কাজ করতে পার না? বেতন তো কম দেই না! এই জগের দাম জানো তুমি? এখন কি তুমি আমাকে কিনে দেবে দামি জগটা?’
রাগের চোটে আবরারকেও ডেকে আনলাম, ভাঙা জগটা দেখালাম ওকে। আবরার এসে সব দেখল। মিনমিন করে কী যেন বলল, আবার চলে গেল। ওর স্বভাবই এমন। আমি ভাবলাম বুয়াকে বকে দেবে, তা না!
এমনিতে আবরার খুব রাগী, কাজকর্মে উনিশ থেকে বিশ হলেই রেগে যায়। কিন্তু বুড়ি বুয়াকে ও কখনো কিছু বলে না। কালও বললাম, বুড়ি বুয়া বাজার থেকে পেঁয়াজ কিনে এনে টাকা কম দিয়েছে। শুনে আবরার বলল, ‘থাক, ছেড়ে দাও। বেশি টাকা না তো!’
অথচ অফিসের পিয়ন সেদিন বিশ টাকা সরিয়েছিল বলে বাসায় এসে পিয়নটাকে চোর-বাটপার বলে গালি দিয়েছিল এই আবরার।
ঈদের আগে জাকাতের টাকার অনেকটা অংশই এই বুড়ি বুয়াকে দিয়ে দেয় আবরার। অথচ আমার বাসায় দুপুরে রান্নার কাজ করে যে মেয়েটি, নাম মল্লিকা। আবরারকে বললেও ওকে তেমন কিছু দিতে চায় না।
আমি জগ ভাঙার টুকরোগুলো নিজের হাতে কুড়াই। পাছে ছেলের পায়ে লেগে পা কেটে যায়! বুয়া বকা খেয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে।
এই ঘটনার কয়েকদিন পরের কথা। সকালের নাস্তা খেতে গিয়ে দেখি আলুভাজিতে এত লবণ দিয়েছে! বুড়ি বুয়াকে আবার বকা দেই। বুয়া বলে, ‘মনের ভুলে লবণ দুইবার পড়ে গেছে।’
আবরার কিন্তু বুয়াকে কিছু বলল না! অথচ রান্নায় এক বিন্দু লবণ বেশি হলে খেতে পারে না আবরার!
সারাক্ষণ কাজকর্মে কিছু না কিছু ভুল করতেই থাকে বুড়ি বুয়া। হয় ফার্নিচার মুছবে না, নয় তো ব্যালকনি মুছতে গিয়ে ফুলগাছের ডাল ভেঙে ফেলবে, রান্নাঘরের কোনায় ময়লা জমে থাকবে, না হয় খাবারের প্লেট-গ্লাস ভাঙবে! আজকে খুব রাগ হলো আমার। নাস্তা খেতে খেতেই চিন্তা করলাম, আর রাখা যাবে না ওকে, আজই বিদায় করে দেব। বুয়াকে ডেকে বললাম, ‘এই মাস শেষ হলে আর কাজ করতে আসবে না তুমি। তোমাকে দিয়ে আর কাজ করাব না। আর চার দিন কাজ করে বেতন নিয়ে বিদায় হও।’
আমার কথা শুনে বুয়া বলল, ‘এই করোনার সময়ে কাজ না করতে পারলে তো না খেয়ে মারা যাব! এই সময় কোন বাড়িতে কাজ খুঁজে পাব!’
ওর কথা শুনে আমার মন গলল না। আমার কথাই শেষ কথা। দিনের পর দিন সংসারের আর কত ক্ষতি মেনে নেব আমি? বিকেলে চা খেতে খেতে আবরার আমাকে বলল, ‘সুস্মি, তুমি বুড়ি বুয়াকে কাজ থেকে বাদ দিয়ো না। এরকম ছোটখাটো ভুল তো আমাদেরও হয়। বুয়া থাক, ও চলে গেলে তোমারও তো কষ্ট হবে!’
আমি কিছু বললাম না। অবাক হয়ে আবরারের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আবরার টিভি দেখতে লাগল।
পরের দিন দুপুরে ছেলের পাশে শুয়ে ওকে ঘুম পাড়াচ্ছিলাম। ঘুম পাড়াতে পাড়াতে আমারও তন্দ্রামতো হয়েছিল। হঠাত্ ফিসফিস কথার আওয়াজে তন্দ্রা ছুটে গেল। শব্দটার দিকে কান পেতে থাকলাম। আবরারের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ও কার সঙ্গে যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। আমি শোয়া থেকে উঠলাম না, সামনেও গেলাম না। সন্দেহ নিয়ে কানটা পেতেই রইলাম। আবরার কার সঙ্গে কথা বলছে? ভালো করে শোনার চেষ্টা করলাম।
শুনতে পাচ্ছি, আবরার বলছে, ‘বুয়া, সুস্মি যেভাবে বলে তুমি সেভাবেই কাজ কোরো। ওকে রাগিও না। ও যেন তোমাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে না দেয়।’
কথা শেষ করে একটু থামল ও। তারপর আবারও বলল, ‘জানো বুয়া, খুব ছোটবেলায় আম্মা মারা গেছেন। আম্মার কথা প্রায় মনেই নেই। শুধু ঈদ এলে আম্মার চেহারার একটা ছবি খুব মনে পড়ে। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিয়ে, কোলে নিয়ে আমাকে সেমাই খাওয়াচ্ছেন আম্মা। ঈদ এলে আমি চোখ বন্ধ করলে আম্মার গায়ের সেই ঘ্রাণটা পাই। কিছুদিন আগে পুরোনো ট্রাঙ্কে একটা বইয়ের ভেতর আম্মার একটা ছবি পেয়েছি, দ্যাখো।’
আমি উঠে এসে আড়াল থেকে দেখলাম, আবরার বুয়াকে আম্মার ছবিটা দেখাচ্ছে। ছবি দেখিয়ে আবরার বলল, ‘দেখো, আম্মা অনেকটাই তোমার মতো দেখতে। কোথায় যেন খুব মিল। বেঁচে থাকলে আম্মার তোমার মতোই বয়স হতো, এমন করেই চুলে পাক ধরত, হয়তো চশমা পরতেন। তোমাকে দেখলে আমার আম্মার কথা খুব মনে হয়। আমার কথাটা রেখো। এই বাড়ির কাজ ছেড়ে কোথাও যেয়ো না তুমি।’