ড. মো. ফখরুল ইসলাম
করোনায় লকডাউনের জন্য রাস্তায় বাস-টেম্পো না থাকায় ভালোই কাটছিল ভ্যানওয়ালা ইউনুসের। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রোগী বহন করে ভালো আয় করেছে সে। রাস্তায় প্রাইভেট কার থাকলেও তেমন জ্যাম না থাকায় দ্রুত খ্যাপ দিয়ে স্বস্তি পাচ্ছিল। ভ্যানে রোগী থাকায় পুলিশ বারবার ধরলেও ছেড়ে দিত। রোগীর স্বজন সঙ্গে থাকায় ওকে পুলিশের সঙ্গে কোনো কথা বলতে হতো না।
১১ আগস্ট ২০২১ রাস্তায় অর্ধেক যানবাহন চলাচলের অনুমতি দেওয়ার ঘোষণা এলে কেউ তা মানেনি। তার আগের রাত থেকে মানুষ সবকিছু নিয়ে রাস্তায় নেমে গেছে। ১২ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সড়ক, রেল, নৌপথে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব যানবাহন চলাচল করার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। গণপরিবহণে, ব্যক্তিগত গাড়ি ও বাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে রাস্তায় চলাচল করতে নির্দেশ দেওয়া হলেও তার অনেক আগেই মানুষ রাস্তায় নেমে যায়। চলাচলকারীদের নানা অজুহাতের কাছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিতরা ছিলেন বড়ই অসহায়। লকডাউনের সময় চলাচলকারী প্রায় সবার কাছে পাশ, আইডি কার্ড, স্টিকার লাগানো গাড়ি থাকায় কাউকে আটকানো সম্ভব হয়নি। অনেককে জেরা করে মিথ্যা বা ভুয়া মনে হলে জরিমানা করা হয়েছে। মামলাও দেওয়া হয়েছে। সেসব মামলার নিষ্পত্তি কীভাবে হয়েছে বা এখনো হয়েছে কিনা জানা যায়নি।
গণপরিবহণ চালুর মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে গাড়িসহ রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার মজাটা আবার শুরু হয়েছে। লকডাউন তুলে নেওয়া হলে দেশের রাস্তা, নদী, রেল ফিরেছে আগের পরিবেশে সেই চিরচেনা চেহারায়। রাস্তা খুলে দেওয়ার প্রথম দিন একটু সহনীয় পরিবেশ থাকলেও দ্বিতীয় দিন থেকে ভোরের আলো ফোটার কিছুক্ষণ পরই প্রায় সব বড় রাস্তার চারকোনা মোড়গুলোতে ভয়ানক জ্যাম লেগে সবাই থেমে যাচ্ছিল। চারদিকের বাস-কার-ভ্যান, রিকশা, টেম্পো, সিএনজি অটোরিকশা সবাই মোড়ের মাথায় পৌঁছেই একযোগে যে যার সামনে মাথা ঢুকিয়ে এগোতে চাইতেই এসে গেল স্থবিরতা। মনে হলো, অনেকদিন কেউ কাউকে হর্ন শোনাননি বা নিজেও শোনেননি। তাই হর্ন দেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। সবাই থমকে থাকলেও কার কী আসে যায়?
বিপত্তি শুধু অ্যাম্বুলেন্সে থাকা মুমূর্ষু রোগীকে নিয়ে। ট্রাফিক পুলিশ হুইসেল বাজিয়ে আন্তরিক তৎপরতা দেখিয়ে অ্যাম্বুলেন্স সামনে যাওয়ার জন্য পথ করে দিতে তৎপর। তবে তিনিও নিষ্ফল, চরম অসহায় এত বড় জ্যামের ভিড়ে। রোগীর নিঃশ্বাসের অস্বাভাবিক ওঠানামায় সঙ্গে থাকা স্বজনদের উৎকণ্ঠা ও কান্না থামানোর মতো কোনো ব্যবস্থা বা পরিবেশ নেই তখন। ভ্যানে রোগী নিয়ে থমকে থাকা ইউনুস চিৎকার করে বলছে- এতদিন লকডাউনেই ভালো ছিলাম। এতদিন চাকা ঘুরত, গাড়ি দৌড়াত। রোগীকে তখন দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে জীবনরক্ষা করেছি। আজ আর পারছি না। ওর মনটা খারাপ তো হলোই, সঙ্গে পাশে বসা রোগীর স্বজনের কান্নায় নিজের চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। রোগীর অক্সিজেনের সিলিন্ডার ফাঁকা হয়ে আসছে। তিনি ছট্ফট্ করছেন, আর বলছেন- পোড়া তেলের গন্ধ আর সহ্য হচ্ছে না!
রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়ির সামনে দিয়ে সেই করোনাকালের আগের মতো ঠেলাঠেলি করে মানুষ রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। কারও মাস্ক থুতনিতে, কারও পকেটে। কারও কারও একেবারেই নেই। ভয়ভীতির কোনো বালাই নেই কারও চোখে-মুখে। করোনা কি তবে উধাও হয়ে গেছে? প্রশ্ন ভ্যানচালক ইউনুসের। কিন্তু কে শোনে তার কথা? আমেরিকা-ইউরোপে লকডাউন শিথিল করে পর্যটন, সি-বিচ খুলে দেওয়ার এক মাসও হয়নি। সেখানে আবার সংক্রমণ ও মৃত্যু শুরু হয়েছে। নিউজিল্যান্ডে পুরো দেশে মাত্র ১৯ জন করোনা রোগী পাওয়ায় সারা দেশে আবারও লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। ওরা কত সচেতন। আমাদের দেশে সংক্রমণ হার ২০ শতাংশ থাকতেই এবং দৈনিক মৃত্যুসংখ্যা দেড় শতাধিক চলা অবস্থাতেই কড়াকড়ি এত শিথিল করে ফেলা হলো কেন? কার স্বার্থে করা হলো এমনটি? মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা না করে করোনা সংক্রান্ত জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির পরামর্শের তোয়াক্কা না করে যদি সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়, তবে স্বাস্থ্যবিধি পালনের তত্ত্বীয় কথা কাকে শোনানো হচ্ছে?
ইন্দোনেশিয়ায় সিনোভ্যাক টিকা নেওয়ার পরও বহু চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষ মারা গেছেন। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে টিকা নেওয়ার পরও কেন আবারও সংক্রমণ ছড়ানো শুরু হয়েছে, সে কথা কেউ কি চিন্তা করছেন? দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পরও আমেরিকায় ডেল্টার আক্রমণে ২৪ ঘণ্টায় আবার লক্ষাধিক সংক্রমণ দেখা গেছে। ফলে ডেল্টা নিয়ে শঙ্কিত আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র। আমরা যেসব টিকা গ্রহণ করেছি, তার মেয়াদ কতদিনের? এর মাধ্যমে সৃষ্ট অ্যান্টিবডি মানব শরীরে কতদিন প্রতিরোধ শক্তি জোগাবে? কলেরা-বসন্তের মতো এখনো করোনার টিকার কার্যকারিতা ও মেয়াদ নিয়ে কোনো কার্যকরী গবেষণা রিপোর্ট গণমাধ্যমে না আসায় আমরা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছি। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, করোনা দু-এক বছর নয়; বরং দু-এক যুগ স্থায়ী হতে পারে। তাই আমাদের অতি সতর্কতার সঙ্গে করোনাকে মোকাবিলার পাশাপাশি এর সঙ্গে উপযোজন বা এডাপ্টেশন করে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। তার আগে হুড়মুড় করে সবকিছু শুরু করতে গেলে ক্ষতির আশঙ্কা প্রবল।
লকডাউন খুলে দেওয়ার পর রাস্তায় গাড়ি বের করা হলেও সব চাকা ঘুরছে না। দৌলতদিয়া ঘাটে ফেরির জন্য লাইন দিয়ে সড়কে তিন দিন ধরে পণ্যবাহী ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। রাজধানীসহ সড়কে শুধু জ্যাম আর জ্যাম। সারি সারি গাড়ি গিজ্ গিজ্ করে পিঁপড়ার মতো দাঁড়িয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে। চলাচলে কোথাও শৃঙ্খলা চোখে পড়ছে না। আমাদের সব পেশাদারিত্বের ওপর মন্দ রাজনৈতিক চর্চা ও অনৈতিক চাপ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর ওপর করোনার মরণকামড়ের মাঝে ডেঙ্গির প্রাদুর্ভাব নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার। দরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ ও জনসচেতনতা।
ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান