ড. এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান
একবিংশ শতাব্দীর ভয়াবহতার প্রথম নামটি করোনাভাইরাস। নামটি সবার মনে আতঙ্কের সঞ্চার করে। ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন রূপ ও মাত্রা যোগ হয়েছে ভাইরাসের সঙ্গে। ২০১৯ সালে চীনের উহান শহর থেকে প্রথম মহামারি করোনাভাইরাসের উৎপত্তি হয়।
পরবর্তী সময়ে ২০২০ সালের মার্চে আমাদের দেশে প্রথম আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। তবে প্রথম থেকে বাংলাদেশে আক্রান্তের গতি ছিল মোটামুটি মন্থর।
এমনকি প্রথম ওয়েভের পর সবকিছু অনেকটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল। কিন্তু ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট আসার পরই দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার অনেকটা বেড়েছে। তবে বিষয়টি এমন যে, আমরা কেউ এমন ভাইরাসের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু ইতিহাস আমাদের প্রস্তুতি নিতে বাধ্য করল, যখন আমরা লক্ষ করলাম ১৭২০ সালে প্লেগ, ১৮২০ সালে কলেরা, ১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লু, এভাবে শতবর্ষের ব্যবধানে ভাইরাসের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
সবার মাঝে কিছুটা ভীতি এবং সঙ্গে সচেতন হওয়ার চেষ্টা শুরু হলো। বিশ্বের সবার চিন্তা এমনই ছিল, ভাইরাস থেকে বাঁচতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয়, পূর্বের ভাইরাসগুলো যতটা ভয়াবহ ছিল, করোনাভাইরাস ততটা ভয়াবহ হয়নি, আর যতটুকু ক্ষতি হয়েছে সেটি আমাদের অসচেতনতার কারণে। তবুও করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সেটি অবশ্যই ভয়ংকর।
যদিও অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশ অনেকটা নিরাপদ আছে, তবুও আমরা ভালো নেই। কারণ নিজের ভালো থাকাটাই তো ভালো থাকা নয়। বরং সমাজের সবাইকে নিয়েই ভালো থাকা। তাই বিশ্বমানবতার এ বিপর্যয় সত্ত্বেও মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মত হিসাবে আমরা নিজেকে নিয়ে ভালো থাকতে পারি না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলতেন, একজন বাঙালি হিসাবে অন্য একজন বাঙালির দুঃখ আমাকে আহত করে। একজন মানুষ হিসাবে বিশ্বমানবতা যখন বিপন্ন হয়, তখন তার থেকে মুক্তির জন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে কাজ করি। জাতির পিতার কথা লালন করে জাতির এ বিপর্যয়ে আমরা ভালো আছি, এটি বলতে পারি না।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর সামাজিক দূরত্ব কথাটি খুব বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। আসলে কথাটি সামাজিক দূরত্ব নয় বরং শারীরিক দূরত্ব হবে। অর্থাৎ মহামারি থেকে রক্ষা পেতে আমাদের শারীরিক নৈকট্য পরিহার করতে হবে। সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে তিন বা চার ফুট দূরে অবস্থান করতে হবে। এক্ষেত্রে শারীরিক দূরত্ব কথাটি ব্যবহার করতে হবে। কারণ সমাজবিজ্ঞানে সামাজিক দূরত্ব বলতে একটি বর্ণ থেকে অন্য একটি বর্ণ কিংবা একটি গোষ্ঠী থেকে অন্য একটি গোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি করা বোঝায়। উদাহরণস্বরূপ সাদা-কালো ভেদাভেদ কিংবা উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন শ্রেণির মধ্যে বৈষম্য। সামাজিক দূরত্ব এটা নয় যে, একজন ব্যক্তি অন্য একজন ব্যক্তি থেকে অসুস্থতা বা কোনো শারীরিক সমস্যার কারণে দূরে অবস্থান করবে।
তবে ক্ষুদ্র অর্থে সামাজিক দূরত্ব বলা যেতে পারে, যখন আমরা খুব বেশি ভিড়ের মধ্যে যাচ্ছি না অথবা বাসে, ট্রেনে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখছি। তবে বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাকল্পে এটি শারীরিক দূরত্ব, সামাজিক দূরত্ব নয়। কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে, এটি হওয়া উচিত শারীরিক দূরত্ব, সামাজিক নয়। আলোচ্য প্রত্যয়টি সামাজিক দূরত্ব হওয়া উচিত নয়, তার অন্যতম একটি কারণ সামাজিক দূরত্ব আমাদের পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করবে, মানসিকভাবে একাকিত্ব সৃষ্টি করবে, এটি কাম্য নয়। আমাদের উচিত শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা।
বৈশ্বিক মহামারির এ সময়ে আমরা যদি সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি করি, তাহলে আমরা বিভিন্ন গ্রুপ, দল, সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব। এছাড়া সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি হলে ক্রমে আমাদের সামাজিক সংহতি নষ্ট হতে শুরু করবে। ‘শারীরিক দূরত্ব’ কথাটি আমরা সাধারণত তখনই ব্যবহার করি, যখন আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়ার ভয় থাকে। সুতরাং করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সামাজিক দূরত্ব কথাটি সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে ভুলভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। করোনা মহামারি থেকে খুব শিগ্গির একেবারে মুক্ত হওয়া যাবে, কথাটি বলা শক্ত। হয়তো অন্য ভাইরাসগুলোর সঙ্গে যেভাবে মানিয়ে চলতে হচ্ছে, করোনাভাইরাসের সঙ্গে সেভাবে চলতে হবে। তাই সামাজিক দূরত্ব প্রত্যয়টি সর্বদা ভুলভাবে ব্যবহৃত হতে থাকলে সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। তাই মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক দূরত্ব কথাটি ব্যবহার করা ঠিক হবে না, শারীরিক দূরত্ব কথাটি ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং সঠিক শব্দটি নির্বাচন করতে হবে।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করা খুব কঠিন কিছু নয়, যদি আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখি। বাড়ির বাইরে গিয়ে ৩-৪ ফুট দূরত্ব বজায় রাখি, নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার করি, তাহলে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে লকডাউনের মাধ্যমে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে না, যদি আমরা স্বাস্থ্যবিধি এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে না পারি।
করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে আমাদের সবার মাঝে এমন শঙ্কা থাকা দরকার যে, আমার পাশের ব্যক্তি সংক্রমিত হতে পারে। তাই দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। আশার দিক হলো, বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সময়োপযোগী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার ফলে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও মহামারির ভয়াল আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছে প্রিয় মাতৃভূমি। এছাড়া দেশে ইতোমধ্যে গণটিকা কার্যক্রম শুরু হয়েছে, যা সরকারের অন্যতম সাফল্য। জনগণকে সচেতন করা এবং টিকা কার্যক্রম যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারলে মহামারির ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাবে দেশ।
প্রফেসর ড. এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান : উপাচার্য, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়