মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্কে যখন বিশ্ব বাণিজ্যে বিরাট ধাক্কা লাগে, তখন দেশটির বাজারে নিজেদের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিতে অংশীদার দেশগুলোর চেষ্টার কোন কমতি ছিল না। সব ধরণের কুটনৈতিক বা অনানুষ্ঠানিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অধিকাংশ দেশ বিফল হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের মন গলাতে। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কমিউনিস্ট শাসিত দেশ ভিয়েতনাম।
বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে শুল্কের হার বাড়াবেন তা আগেভাগেই আঁচ করতে পেরে দেশটির গৃহীত অভিনব পদক্ষেপের কারণেই শেষ পর্যন্ত ২৬ শতাংশ শুল্কে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। আমরা দেখে নেব, ভিয়েতনাম আসলে কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল-যার ফলশ্রুতিতে এই অর্জন করতে পেরেছে তারা।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে আমরা জানতে পারছি, সংকট উত্তরণের অংশ হিসেবে বিনা শুল্কের উন্মুক্ত বাজার করার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভিয়েতনাম। গত সপ্তাহে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, ৭৮০ কোটি ডলারে ৫০টি বোয়িং উড়োজাহাজ কেনার চুক্তি চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে ভিয়েতনাম এয়ারলাইন কর্তৃপক্ষ। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৯০ কোটি ডলার সমমূল্যের কৃষিজাত পণ্য কেনারও চুক্তি করতে যাচ্ছে ভিয়েতনাম।
যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর শুল্কের হার শূন্য করে মার্কিন কম্পানিগুলোর জন্যও এসইউভির (বৈদ্যুতিক গাড়ি) বাজার উন্মুক্ত করে দিয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি। এই সুবিধার কারণে বড় ইঞ্জিনের গাড়ি ভিয়েতনামের বাজারে শুল্ক ছাড়াই রপ্তানি করতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প বলেন, ‘ভিয়েতনাম এমন কিছু করতে যাচ্ছে, যা তারা আগে কখনো করেনি। তারা আমাদের বাজারে পূর্ণ প্রবেশাধিকার দেবে।’তবে ভিয়েতনাম থেকে পণ্য ট্রান্সশিপিংয়ের ক্ষেত্রে শুল্ক হবে ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ যদি অন্য কোনো দেশ তাদের পণ্য ভিয়েতনামের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায়, তাহলে সেসব পণ্যে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত অনেক বেশি বলে আগে থেকেই সতর্ক দৃষ্টি ছিল ভিয়েতনামের। গেল বছর ভিয়েতনাম থেকে ১৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্র। ভিয়েতনামের বাণিজ্য উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার, ২০২৩ সালের চেয়ে যা ১৮.১ শতাংশ বেশি।
গত ২ এপ্রিল ভিয়েতনামের ওপর ৪৬ শতাংশ পাল্টা শুল্ক ধার্য করেন ট্রাম্প। শুল্ক নিয়ে যৌক্তিক সমাধানে আসার ক্ষেত্রে কোনো কমতি রাখেনি ভিয়েতনাম। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে শুল্কের পরিমাণ ৯০ শতাংশ থেকে শূন্যে নামিয়ে আনার ব্যাপারে ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপ করেন ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি তো লাম। এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানির হার বাড়ানোর বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেন।
ভিয়েতনামে বিনিয়োগ বাড়াতে মার্কিন ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করতে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা হবে বলেও জানান। একই সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যচুক্তি স্বাক্ষরের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্পকে ভিয়েতনামে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি। সে সময় এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে তো লামের সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন ট্রাম্প। ফোনালাপের পর নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ইতিবাচক একটি পোস্টও দিয়েছিলেন ট্রাম্প।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তর বা ইউএসটিআরের সঙ্গে তিনবার আলোচনায় বসে ভিয়েতনামের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গত ১৬ মে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে ভিয়েতনাম-যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম আলোচনা হয় দক্ষিণ কোরিয়ার জেজুতে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে দ্বিতীয় দফার আলোচনা ১৯ থেকে ২২ মে পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। তৃতীয়বারও যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে আলোচনা হয়। চার দিনব্যাপী এই আলোচনা চলে ৯ থেকে ১২ জুন পর্যন্ত।
ভিয়েতনাম রপ্তানি পণ্যে শুল্কের হার শূন্যে নামিয়ে আনতে চেয়েছিল। সে চাওয়া পূরণ না হলেও গত সপ্তাহে ২০ শতাংশ শুল্ক ধার্য করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে ২৬ শতাংশ শুল্ক কমানোর প্রক্রিয়াটিও ভিয়েতনামের জন্য সহজ ছিল না। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত মে মাসের শেষ দিকেই শর্তের তালিকা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। শুল্কের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে নমনীয় করতে কঠিন সব শর্ত মানতে হয়েছে ভিয়েতনামকে। সবচেয়ে কঠিন ছিল চীনা পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমানোর শর্ত। বাণিজ্যচুক্তি ব্যবহার করে চীনের ওপর চাপ প্রয়োগ করতেই এমন শর্ত দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
তারা চায়নি ভিয়েতনামভিত্তিক কারখানাগুলোতে চীন থেকে আমদানি করা কাঁচামাল ও উপাদান ব্যবহৃত হোক। দীর্ঘদিন ধরেই চীনের সঙ্গে ভিয়েতনামের সুসম্পর্ক রয়েছে। ভিয়েতনামের অন্যতম বড় বৈদেশিক বিনিয়োগকারী চীন। সম্পর্কে ভাটা পড়লে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীনের সঙ্গে পুরনো দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিতে পারে। ভিয়েতনামের জন্য এই পরিস্থিতি ছিল উভয়সংকটে পড়ার মতো। কারণ সবচেয়ে বেশি পণ্য তারা চীন থেকেই আমদানি করে। জুতা, আসবাব, ইলেকট্রনিকস—সব কিছু উৎপাদনের কাঁচামাল চীন থেকে আনে তারা। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয় সেটি তাদের মোট জিডিপির ৩০ শতাংশ।