ইউরোপের যে কোনো দেশে একজন ব্যক্তি রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করতে পারবেন ডাবলিন বিধিমালার ওপর। কিন্তু যারা ট্যুরিস্ট বা ভ্রমণ ভিসায় আসেন তাদের ক্ষেত্রেও কি ডাবলিন বিধিমালা কার্যকর হবে?
সাধারণত ডাবলিন বিধিমালা অনুযায়ী একজন ব্যক্তি সর্বপ্রথম ইউরোপের যে দেশে আসবেন তাকে সেই দেশে তার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করতে হবে। ভ্রমণ ভিসায় আসা ব্যক্তিদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের ক্ষেত্রে ডাবলিন চুক্তি প্রয়োগ হবে কি না সে বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।
ইতালিতে ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে বেলজিয়ামে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিলেন আকুমা (ছদ্মনাম) নাম। কিন্তু তাকে পুনরায় ইতালি ফেরত পাঠানো হয়। কারণ তিনি ইতালির ভিসা নিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছেন। কিন্তু আকুমা মনে করেন তাকে ইতালি ফেরত পাঠানো সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
আকুমা মূলত ক্যামেরুনের ইংরেজি ভাষাভাষী অঞ্চল থেকে এসেছেন। তিনি স্থানীয় একটি ট্রাভেল এজেন্সির সহায়তায় ইতালির ভ্রমণ ভিসা পান। ট্রাভেল এজেন্সিটি আদম পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তাদের ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয়ের ব্যাপারে কোনো ধারণা ছিল না। তাদের দেওয়া তথ্যগুলোর কোনো আইনি ভিত্তি ছিল না।
ইউরোপের শেনজেন অঞ্চলে যেহেতু ভিসা ছাড়া ভ্রমণ করা যায়, সেই সুযোগে তিনি ভ্রমণ ভিসায় ইতালিতে আসার পরে একটি বিমানের টিকিট কেটে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের উদ্দেশে যাত্রা করেন। কারণ সেখানে তার বন্ধুবান্ধব এবং অনেক আত্মীয়-স্বজনরা বসবাস করেন।
ব্রাসেলস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পরে তিনি বিমানবন্দরের বিশেষ কাউন্টারে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন। কিন্তু তার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন গ্রহণ করার পরিবর্তে ডাবলিন বিধিমালার আওতায় তাকে বেলজিয়াম সরকার ইতালি ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
‘ইতালিতে স্থানান্তর প্রক্রিয়াটি থামানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। কোনো অপরাধ না করেও আমি প্রায় ৮৪ দিন বেলজিয়ামের একটি ডিটেনশন সেন্টারে বন্দি ছিলাম। আমার সঙ্গে কোনো মোবাইলফোন ছিল না। এমনকি যোগাযোগের জন্য পর্যাপ্ত কোনো সুযোগ ছিল না,’ বলেন আকুমা।
অবশেষে তিনি ইতালিতে তার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করে সফল হন কিন্তু সেখানে তার কোনো চাকরি এবং পর্যাপ্ত সামাজিক সহায়তা নেই।
‘আমি ইতালিতে এসে এখন আটকা পড়ে আছি। ইতালির ভাষা না জানার কারণে আমার কোনো চাকরি নেই, পর্যাপ্ত সামাজিক সুরক্ষা, চিকিৎসা এবং মানসিক সহায়তারও কোনো সুযোগ নেই,’ যোগ করেন আকুমা।
ট্যুরিস্ট ভিসায় ভ্রমণ এবং রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন
আকুমাকে বেলজিয়াম থেকে ইতালিতে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া ঠিক কী ছিল জানা না থাকলেও এক্ষেত্রে বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। ইউরোপীয় কাউন্সিল ফর রিফিউজিস অ্যান্ড এক্সাইলস (ইসিআরই) এর আশ্রয় বিশেষজ্ঞ পেট্রা বায়েন্সের সহায়তায় আমরা বেশ কিছু বিষয় পরিষ্কার করতে পেরেছি।
প্রথমত, স্বল্প মেয়াদি ভ্রমণ ভিসায় ইউরোপ ভ্রমণ করা (যেমন ট্যুরিস্ট ভিসা) এবং ইউরোপে একবার আশ্রয় জন্য আবেদন করা সম্ভব। এই নিয়মটি ইউরোপে প্রবেশে ভিসা-অব্যাহতিপ্রাপ্ত দেশগুলো যেমন নির্দিষ্ট কিছু বলকান দেশ, জর্জিয়া বা ভেনিজুয়েলা থেকে আসা লোকদের জন্যও প্রযোজ্য।
শেনজেন ভিসা বা সি-ভিসা নামে পরিচিত স্বল্প-স্থায়ী ভিসা মূলত সমগ্র শেনজেন অঞ্চলের জন্য দেওয়া হয়, যার সাহায্যে অঞ্চলটির যেকোনো দেশে ভ্রমণ করা সম্ভব হয়।
যদি রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদন করার সিদ্ধান্ত নেন তবে সেক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ আপনি কোনো দেশের ভিসা নিয়ে প্রবেশ করেছেন সেটি খুঁজে বের করবে। যেটি নির্ধারণ করবে আপনি কোথায় আপনার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন জমা করতে পারবেন।
আপনি যদি ইতালির দেওয়া ভিসায় বেলজিয়াম ভ্রমণ করেন তবে সেক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী ইতালি আপনার আশ্রয় আবেদনের জন্য দায়বদ্ধ এবং আপনাকে সেখানে ফিরে যেতে হবে।
ভিসার মেয়াদ শেষ হলে?
আপনি যদি আপনার ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও শেনজেন অঞ্চলে থাকেন তবে এই অতিরিক্ত সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভিসা বিষয়ক সিস্টেমে রেকর্ড করা হবে।
পেট্রা বায়েন্সের মতে, কোনো ব্যক্তি যদি ভিসার মেয়াদকাল অতিক্রম করেন এবং আবেদন বৃদ্ধি অথবা কোনো বৈধ প্রক্রিয়া শুরু না করেন, তবে সেক্ষেত্রে ইউরোপে তার উপস্থিতি হবে সম্পূর্ণ অবৈধ এবং উক্ত ব্যক্তি যেকোন মুহূর্তে বহিষ্কারের ঝুঁকিতে থাকবেন।
তবে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ অতিক্রম করার পরেও কোনো ব্যক্তি চাইলে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন চালিয়ে যেতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে কোনো ব্যক্তি আশ্রয় আবেদন জমা দিতে যত বেশি সময় নেবেন তার আশ্রয় আবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতায় ততবেশি বিরূপ প্রভাব পড়বে।
ভুয়া ভিসায় ভ্রমণ করলে?
যদিও আমরা জানি না যে কোনোভাবে আকুমা ট্যুরিস্ট ভিসা যোগাড় করেছিলেন, তবে জাতিসংঘের মতে, এসব ক্ষেত্রে ট্রাভেল এজেন্ট এবং আদম পাচারকারীদের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
এ কারণে ইনফোমাইগ্রেন্টসের পক্ষ থেকে পেট্রা বায়েন্সের কাছে জানতে চাওয়া হয়, জাল ভিসায় ইউরোপে যাতায়াত করে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে কি পরিণতি হয়ে থাকে?
উত্তরে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এক্ষেত্রেও রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করা সম্ভব এবং কর্তৃপক্ষকে আবেদনগুলোকে আশ্রয় আইন অনুসারে পরীক্ষা করতে হবে। আশ্রয় আইনের বিধান অনুযায়ী কোনও ব্যক্তিকে এমন দেশে ফেরত পাঠানো যাবে না যেখানে তার জীবন শঙ্কায় পড়তে পারে এবং সেখানে তিনি নিপীড়নের শিকার হতে পারেন।
তবে এই বিশ্বাসযোগ্যতা মাপার মানদন্ডগুলো বিভিন্ন দেশের জন্য বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। যেমন তালিকায় নিরাপদ দেশ হিসেবে থাকা এমন কোনও দেশ থেকে আসা ব্যক্তির আবেদন গ্রহণের জন্য আবেদনকারীকে অনেক প্রমাণ হাজির করতে হবে।
তবে, কেউ যদি কোনো মিথ্যা নথি বা তথ্যের সাহায্য নিয়ে ভ্রমণ করে থাকেন সেক্ষেত্রে তাকে আটকে রাখার ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়া এটি তার আশ্রয় আবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
আশ্রয় আবেদনে যদি কেউ কোনও মিথ্যা তথ্য বা ডকুমেন্ট ব্যবহার করে ধরা পড়েন, সেক্ষেত্রে আবেদনটি দ্রুত প্রক্রিয়াতে স্থানান্তরিত করা হতে পারে। এর অর্থ হচ্ছে কোনও দেশ সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে, আপনার আশ্রয় আবেদনটি আসলে ভিত্তিহীন কারণ এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আপনি প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন।